হুমায়ূন কবীর
প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৪৬ পিএম
ফাইল ফটো
পেপার লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) পরিবর্তে দেশের ৯ কোটি নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দিতে ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাক্সেস টু সার্ভিস (আইডিইএ)’ প্রকল্প হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১১ সালে গৃহীত হওয়ার পর এক যুগে ছয়বার মেয়াদ বেড়েছে প্রকল্পটির। শেষ পর্যন্ত গত বছর জুনে এ প্রকল্প শেষ হয়েছে।
কিন্তু এখনও দেশের ৯ কোটি নাগরিক স্মার্টকার্ড হাতে পাননি। আরও ৩ কোটি নাগরিককে স্মার্টকার্ড দিতে নতুন প্রকল্প নেওয়ার সময়ও দুই বছর পেরিয়ে গেছে। নতুন প্রকল্প ২০২৫ সালের নভেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা। যদিও এখন পর্যন্ত কেবল সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
ইসি আশা করছে, স্মার্টকার্ড মিলবে আগামী এপ্রিল-মে মাসে। তবে এনআইডি সংশোধন বা হারিয়ে গেলে সহসাই মিলবে না স্মার্টকার্ড। এক্ষেত্রে আপাতত আগের মতো লেমিনেটেড এনআইডিই ভরসা নাগরিকের।
স্মার্টকার্ড পারসোনালাইজেশনের জন্য বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) কাছে ইসির দেনা প্রায় শতকোটি টাকা। যা পরিশোধে দফায় দফায় ব্ঠৈক চলছে। এদিকে ইসিকে স্মার্টকার্ড দিতে ২০১৫ সালে ফ্রান্সের কোম্পানি ওবারথার টেকনোলজিসের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু সময়মতো কার্ড দিতে না পারায় কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ আর বাড়ায়নি কমিশন। পরে দেনা-পাওনা অনিষ্পন্ন থাকায় আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে মামলা করে ওবারথার টেকনোলজিস। দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে একটি সেটেলমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্টও স্বাক্ষরিত হয়। সে অনুযায়ী ওবারথার ইসিকে পাওনা কার্ড দিলেও কমিশন এখনও তাদের সব পাওনা পরিশোধ করতে পারেনি। তাই সেটেলমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অজুহাতে আবারও আরবিট্রেশন হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই ওবারথার টেকনোলজিসের পাওনা পরিশোধে তোড়জোড় শুরু হয়েছে ইসিতে।
৯ কোটি নাগরিককে স্মার্টকার্ড দিতে ২০১১ সালে আইডিয়া প্রকল্প হাতে নেয় কমিশন। যার মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত। কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ছয় দফায় এর মেয়াদ করা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ থাকা প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৬৯৬৬৩.৫৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে জিওবি ছিল ৮৯৮৫৯.৫০ লাখ টাকা এবং প্রকল্প সাহায্য ৭৯৮০৪.০৭ লাখ টাকা। প্রকল্প নেওয়ার প্রায় চার বছর পর ২০১৫ সালে স্মার্টকার্ড উৎপাদন-বিতরণের জন্য ওবারথার টেকনোলজিসের সঙ্গে চুক্তি হলেও স্মার্টকার্ড বিতরণ শুরু হয় ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর থেকে। ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এই বিষয়ে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে সরকারি তহবিল থেকে এই প্রকল্পের ব্যয় মেটানো হয়।
এরই মধ্যে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর আইডিয়া-২ প্রকল্প একনেকে পাস হয়। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। এর মেয়াদকাল ধরা হয় ডিসেম্বর ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। এই প্রকল্পের অধীনে ৩ কোটি নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দিতে ৪৮০ কোটি টাকা সংস্থান রাখা হয়েছে। এখনো নতুন স্মার্টকার্ড হাতে পায়নি কমিশন। তবে এই ৩ কোটি কার্ডের জন্য সমঝোতা স্মারক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
সম্প্রতি আইডিয়ার দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ওবারথার টেকনোলজিসের বকেয়া পাওনা পরিশোধের প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য চিঠি দিয়েছেন ইসির সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। এতে তিনি সদ্যসমাপ্ত আইডিইএ প্রকল্প থেকে ওবারথার টেকনোলজিসের বকেয়া পাওনা ০.৫৫৬ মিলিয়ন (৫৫৬,০০০ মার্কিন ডলার) ডলার আইডিইএ দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্প থেকে পরিশোধের কথা উল্লেখ করেছেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আইডিইএ প্রকল্পের জি-৪ প্যাকেজের আওতায় ৯০ মিলিয়ন স্মার্টকার্ড সরবরাহের লক্ষ্যে ওবারথার টেকনোলজিসের সঙ্গে ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কার্ড সরবরাহ করতে না পারায় চুক্তির মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি।
তবে ওবারথার ও ইসির মধ্যে কিছু দেনা-পাওনা রয়ে যায়। ওই পাওনা আদায়ের জন্য ওবারথার টেকনোলজিস ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনালে মামলা করে। পরে দেনা-পাওনা নিষ্পত্তির জন্য ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ওবারথার ও ইসির মধ্যে একটি সেটেলমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ওবারথার ইতোমধ্যেই কার্ড সরবরাহ করেছে। যদিও প্রকল্পের কাছে ওবারথারের এখনও ০.৫৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা রয়েছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পের যাবতীয় কাজ আইডিইএ দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পের আওতায় চালু রাখতে একনেক সভার সিদ্ধান্ত রয়েছে। ওবারথার টেকনোলজিসের বকেয়া পাওনা আইডিইএ প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায় থেকে পরিশোধের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের সম্মতি রয়েছে। তবে প্রকল্পের ডিপিপিতে এই অর্থের বরাদ্দ নেই। যার ফলে ডিপিপি সংশোধন করা দরকার। যা অল্প সময়ে সম্ভব নয়। ওবারথার টেকনোলজিসের পাওনা সময়মতো পরিশোধ না করলে আবারও আরবিট্রেশন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ফলে সরকারের আর্থিক ক্ষতিও হতে পারে। তাই আইডিইএ দ্বিতীয় পর্যায় থেকে ওবারথার টেকনোলজিসের পাওনা পরিশোধ এবং পরে প্রকল্পটির সংশোধিত ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্তি সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়ার অনুরোধ করা হয় চিঠিটিতে।
আইডিইএ প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিচালক হিসেবে সদ্য যোগ দিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েম। ওবারথার টেকনোলজিসের কাছে পাওয়া কার্ডের বিষয়ে তিনি গত বুধবার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘কার্ডগুলো আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘ওদের (ওবারথার টেকনোলজিস) সঙ্গে অন্য কিছু দেনা-পাওনা আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের যে মামলাটা ছিল, সেটি টার্মিনেট হয়ে গেছে। কিন্তু কিছু লেনদেনের বিষয় প্রক্রিয়াধীন আছে। এটি নিয়ে কাজ হচ্ছে। আশা করি, দ্রুতই এর সমাধান হয়ে যাবে।’
নতুন স্মার্টকার্ড কবে নাগাদ পাওয়া যাবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চলমান প্রজেক্টের আওতায় ৩ কোটি স্মার্টকার্ড দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ আর্মির সঙ্গে আমাদের এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) চুক্তি হয়েছে। সেটির ডেলিগেটেড প্রকিউরমেন্ট নিয়ে তারা কাজ করছেন। বাংলাদেশ আর্মি এটা বিএমটিএফের মাধ্যমে করাবে। তারা মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করছে। আশা করছি, এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে ব্ল্যাঙ্ক স্মার্টকার্ডগুলো পাব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটির মতো ব্ল্যাঙ্ক স্মার্টকার্ড আছে। নতুন ৩ কোটি যোগ হলে সাড়ে ৪ কোটির মতো হবে। এই প্রকল্পের যতটা টার্গেট আছে, ততটা প্রিন্ট করার মতো ব্ল্যাঙ্ক স্মার্টকার্ড আমাদের আছে।’
চলমান প্রকল্পের মেয়াদ বা আগামী ২০২৫ সালের নভেম্বরের মধ্যে কি সব নাগরিকের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেওয়া যাবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবার হাতে তুলে দেওয়া যাবে কি না, তা আরেকটু ওয়ার্কআউট করে বলতে হবে। কারণ, এখন পর্যন্ত আমাদের সার্ভারে ১২.৮৮ কোটি ভোটারের তথ্য আছে। যা প্রতিবছরই বাড়ছে। তাই সময় আরেকটু বেশি লাগতে পারে।’
নতুন ৩ কোটি স্মার্টকার্ড দেশীয় পর্যায়ে তৈরি কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এগুলো দেশি না। বাংলাদেশ আর্মির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে- এবারও আগেরবারের মতো মানসম্মত কার্ড দেওয়া হবে। এটি তারা ফ্রান্স এবং চীন থেকে আনবে।’
স্মার্টকার্ড পারসোনালাইজেশন-সংক্রান্ত বিএমটিএফের পাওনার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালক বলেন, ‘এটি তো আগের ইস্যু। এগুলো একটি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের সমাধা করতে হবে। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
কমিশন ও বিএমটিএফ থেকে উল্লেখিত টাকার পরিমাণে পার্থক্যের বিষয়টি নজরে আনলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত বলেন, ‘এটি আমাদের আলোচনার পর্যায়ে আছে। এটির সমাধানে কিছু সময়ও লাগবে। কারণ, এটি একটি প্রায় ৯৭ কোটি টাকার মতো ইস্যু। কমিশনের সিদ্ধান্ত এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এটি দেওয়া হবে।’
প্রকল্প পরিচালক বলেন, ৭ কোটি ৩০ লাখের মতো কার্ড প্রিন্ট করা হয়েছে। সবগুলো বিতরণ করা হয়নি। এক কোটির কিছু বেশি কার্ড বিতরণের জন্য মাঠপর্যায়ে আছে। কার্ডগুলো বিতরণের জন্য সব জেলা-উপজেলায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনেক কার্ড হোল্ডার আছেন যারা বিদেশে থাকেন, বাইরে চলে গেছেন, অনেকে অসুস্থ আছেন, অনেকে মারা গেছেন। এ রকম বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক কার্ড বিতরণও হয়নি। কিন্তু চেষ্টা করা হচ্ছে এবং এগুলোর বিতরণ অব্যাহত আছে।
এনআইডি সংশোধন করলে বা হারিয়ে গেলে স্মার্টকার্ড নতুন করে কবে থেকে ইস্যু করা হতে পারে?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের পলিসি হচ্ছে, দেশের প্রতিটি নাগরিককে একটি করে কার্ড দেওয়া হবে। এটি ফ্রি দেওয়া হবে। আমাদের প্রায়োরিটি হচ্ছে, সবাইকে একটি করে কার্ড দেওয়া হবে। কেউ যদি ভুল করে থাকে বা সংশোধনের প্রয়োজন হয় বা হারিয়ে যায়, যেটাই হোক, সেটি আমাদের প্রায়োরিটি না। সংশোধন বা হারিয়ে গেলে, আপাতত পেপার লেমিনেটেড কার্ড আছে, সেটি পাবেন। সেটি নিয়ে চলতে পারবেন।’
তিনি জানান, স্মার্টকার্ড রিপ্রিন্ট কবে থেকে হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন ভবনের বেজমেন্টে আইডিয়া প্রকল্প প্রথম পর্যায়ের ১ কোটি ৩৫ লাখ এবং পার্সোনালাইজেশন সেন্টারে ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৯৬৭টিসহ ইসির হাতে মোট ১ কোটি ৫২ লাখ ৮৩ হাজার ৯৬৭টি ব্ল্যাঙ্ক স্মার্টকার্ড রয়েছে। কার্ড প্রিন্ট হয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ ৭৮ হাজার ২৫১টি। আর বিতরণের জন্য মাঠপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে ৭ কোটি ২৭ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫৭টি স্মার্টকার্ড।