লক্ষ্মীপুর প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৫১ পিএম
মেঘনা নদীর দ্বীপ-চরগুলোর মহিষের বাথান। প্রবা ফটো
লক্ষ্মীপুরের ঐতিহ্য মহিষের কাঁচা দুধের তৈরি টক দই। এটি স্থানীয়ভাবে মহিষা দই হিসেবে পরিচিত। সুস্বাদু ও জনপ্রিয়তায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর সুনাম রয়েছে। যুগ যুগ ধরে সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এটি সবার পছন্দনীয় খাবার। নানান কারণে উৎপাদন কম হলেও এর ব্যাপক চাহিদ রয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষজনের পছন্দের তালিকায় মহিষা দই অন্যতম।
ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় প্রতিদিন ১০ টনেরও বেশি মহিষা দই উৎপাদন হয়। আর বছরে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টন দই বেচাকেনা হয়। এতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টন দুধ প্রয়োজন হয়। জেলার পশ্চিম ও দক্ষিণের মেঘনা নদীর দ্বীপ-চরগুলোর মহিষের বাথান থেকে এ দুধ আসে। বিশেষ করে মেঘনার চর, চর শামছুদ্দিন, চর আবদুল্লাহ, কানিবগারচর ও চরকাছিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার মহিষের বাথান থেকে এ দুধ সংগ্রহ করে দই উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত এ দই ২০০ টাকা কেজি ধরে বিক্রি করা হয়। এতে বছরে প্রায় ৭০ কোটি টাকার দই বেচাকেনা হয়।
জেলা শহরের বাসিন্দা চাকরিজীবী হাবিবুর রহমান, জামাল উদ্দিন, ব্যবসায়ী রাকিব হোসনে ও নিজাম বেপারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাঁচা দুধ দিয়ে মহিষের দই তৈরি হয়। মুখে দিতেই অন্যরকম অনুভূতি পাওয়া যায়। রুচিশীল এ দুই এ জেলায় বেশ জনপ্রিয়। সুযোগ পেলেই সদরের মজু চৌধুরীর হাট, কাঞ্চনিবাজার, রায়পুরের মোল্লারহাট, হাজিমারা ছুটে যান তারা। শহরের কাছাকাছি এসব এলাকায় ভালো দই পাওয়া যায়। শুধু নিজেরাই নন, বাড়ির জন্যও দই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন।
দই তৈরি নিয়ে ব্যবসায়ী সুমনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চর থেকে কাঁচা দুধ সংগ্রহ করে আনার পর ১ থেকে ২ কেজি ধারণকৃত মাটির পাত্রে ঢালা হয়। পাত্রগুলোকে স্থানীয় ভাষায় টালি বলা হয়। টালিতে দুধ রাখার ১৫-১৬ ঘণ্টা পর দুধ জমে দই হয়। প্রতি লিটার দুধে ৯৫০ গ্রাম দই পাওয়া যায়। ফ্রিজিং করা ছাড়াই এ দই এক সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকে। দই বসানো টালিগুলো পটুয়াখালি, বরগুনা ও পিরোজপুর থেকে আনা হয়। বর্তমানে আকার অনুযায়ী, প্রতিটি টালি ১৬-২০ টাকা দাম পড়ে। মহিষা দই থেকে মাখন, ঘি ও ঘোল বানানো গেলেও লক্ষ্মীপুরে সেসব তৈরি হয় না।
দই বিক্রেতা সুমন হোসেন বলেন, জেলা শহরসহ ৫টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তিনি পাইকারিভাবে দই বিক্রি করেন। গরুর দুধের দইয়ের চেয়ে মহিষের দই বেশ জনপ্রিয়। জেলার ছোট-বড় ৪০টি হাটবাজারে প্রতিদিন প্রায় ১০ টনের বেশি দই বিক্রি হয়। এতে দিনে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকার দই বিক্রি করে থাকেন দোকানিরা। এরমধ্যে রামগতি উপজেলার মহিষের দই পুরো জেলায় জনপ্রিয়।
দুধ বিক্রেতা আবদুর রব মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহিষের দুধের তৈরি দই সবচেয়ে ভালো। যুগযুগ ধরে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এখন মহিষ সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এতে দুধ উৎপাদন কম হচ্ছে। কারণ মহিষ উৎপাদনে মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। চরাঞ্চল কমে যাওয়া ঘাসের সংকট রয়েছে। খাদ্য সংকট ব্যাপক প্রভাব ফেলছে মহিষ পালনে। মহিষ পালন বাড়লে দুধ উৎপাদনও বাড়বে।
জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার চরাঞ্চলেই মহিষের উৎপাদন বেশি। মেঘনা নদীর ১২টি দ্বীপ-চরসহ মূল ভূখণ্ডে প্রায় ২০ হাজার মহিষ পালন করা হয়। এরমধ্যে রামগতি উপজেলার বিভিন্ন দ্বীপ-চরে ৬ হাজার ৩০০, কমলনগরে ৬ হাজার, সদর উপজেলায় ৫ হাজার ৭০০ এবং রায়পুরে ১ হাজার ২০০ মহিষ পালন করা হয়। তবে স্থানীয় কয়েকজন বাথান মালিক জানিয়েছেন, প্রকৃত পক্ষে সরকারি হিসাবের দ্বিগুণ মহিষ পালন করা হয়।
মহিষ মালিক শাহজাহান মাঝি, আবু মোহাম্মদ ও হামিদুর রহমানসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার বিভিন্ন চরে প্রায় ৫০ হাজার মহিষ পালন করা হয়। এ মহিষগুলোর অন্যতম খাবার প্রাকৃতিক ঘাস। এসব মহিষ দুধ ও মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যেই পালন করেন মালিকরা।
কমলনগরের তোরাবগঞ্জ বাজারের দই বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন প্রায় ১৭ বছর এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে দই বাধ্যতামূলক। খাবারের শেষ মুহূর্তে দই না হলে চলেই না। তিনি জানান, তাদের প্রতি কাপে ২৫০ গ্রাম দই থাকে। অনেকে পাতিল হিসেবেও অর্ডার করেন। এসব অনুষ্ঠানে গরুর দই অর্ডার খুব কম পাওয়া যায়। তিনি দৈনিক ২০০-২৫০ কেজি দই বিক্রি করেন তিনি। দুধের দাম বেশি হওয়ায় দইয়ের দামও বেড়েছে। দুধের দামের সঙ্গে দইয়ের দাম কমবেশি হয়।
দই উৎপাদনের কাজে ব্যস্ততা। প্রবা ফটো
তোরাবগঞ্জ বাজারের জামাই ডেকোরেটরের ব্যবস্থাপক আজগর হোসেন রুবেল বলেন, প্রায় ৪ মাস ধরে আমি ডেকোরেটরের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রায় ৩০টি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে সবখানেই মহিষের দই আপ্যায়নে রাখতে দেখেছি। এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম খাবার মহিষা দই।
জেলা শহরের বাবুর্চি আবুল কালাম বলেন, খাবার শেষে এ দই মুখরোচক। গরুর দুধের বা গুড়ো দুধের মিষ্টি দইয়ের চাহিদা কম। রামগতি, কমলনগর, সদর ও রায়পুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে মেহেমানদের জন্য মহিষা দই থাকতেই হবে।
রামগতি উপজেলার মহিষের বাথানের মালিক রফিক উল্যাহ ও সদরের আবদুল কুদ্দুস বেপারী জানান, দিন দিন চরাঞ্চলে মানুষ বাড়ছে। এতে মহিষের চারণভূমি কমে যাচ্ছে। ঘাস উৎপাদনের জমিগুলোতে এখন চাষাবাদ হচ্ছে। এসব কারণেই এখন মহিষ পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে অনেকেই মহিষ পালন ছেড়ে দিচ্ছেন। তারা অন্য ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. যোবায়ের হোসেন বলেন, মহিষের দই অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। জেলায় প্রতিদিন ১০ টনের বেশি মহিষের দধি উৎপাদন হয়। দিনি দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহিষ পালন ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা খামারি ও বাথান মালিকদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছি। চেষ্টা করছি মহিষ পালন বাড়ানোর জন্য।