সাতক্ষীরা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪৮ পিএম
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার চরাঞ্চলের চাঁদনীমুখার বাসিন্দা সায়রা খাতুন পাশের গ্রামের একটি পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। প্রবা ফটো
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার চরাঞ্চলের চাঁদনীমুখা গ্রাম। গ্রামের চারপাশে পানি থইথই করছে, কিন্তু কোথাও নেই খাবার পানি। এই গ্রামের বাসিন্দা সায়রা খাতুন। ৬৫ বছরের এই বিধবা খাবার পানির খোঁজে প্রতিদিন সকালে বের হয়ে ৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাশের পারশামারি গ্রামের একটি পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করেন। সায়রা খাতুনের মতো গ্রামের আরও নারীরা দল বেঁধে বের হন পানির সন্ধানে।
সায়রা খাতুনের স্বামী সোলেমান গাজী মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কারও সংসারে জায়গা হয়নি সায়রা খাতুনের। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসেও তাকে খাবার পানির জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। শুধু চাঁদনীমুখী গ্রাম বা সায়রা খাতুনই নয়, খাবার পানির জন্য নিত্যদিনের লড়াই চলছে গাবুরা ইউনিয়নের প্রায় ১০ গ্রামের মানুষের।
সায়রা খাতুন বলেন, আমাদের এখানে পানির তীব্র সংকট। স্বামী মরে যাওয়ার পর আমার দেখার মতো কেউ নেই। ছেলেরাও আলাদা থাকে। এমনিতেই তিনবেলা খেতে পারি না, তার ওপর পানি কিনব কী দিয়ে। তাইতো সকাল থেকেই শুরু হয় পানি সংগ্রহ করার কাজ। তিনি বলেন, বৃষ্টির পানি ধরে পান করতে পারি, তার জন্য ড্রাম লাগে। সেই ড্রাম কেনার টাকাও নেই।
সায়রা খাতুনের মতো প্রতিদিন পানির সন্ধানে নামেন চাদঁনীমুখা গ্রামের আরেক নারী করিমন নেছা। তিনি জানান, ২০০৯ সালের ২৫ মে ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকা। ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে সুন্দরবন উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায়। শেষ হয়ে যায় হাজার হাজার গবাদিপশু আর ঘরবাড়ি। নিমেষেই গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। চিংড়িঘের আর ফসলের ক্ষতি ছিল অবর্ণনীয়। ধ্বংস হয়ে যায় উপকূল রক্ষা বেড়ি বাঁধ। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় অসংখ্য ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নষ্ট হয়ে যায় এসব এলাকার অধিকাংশ টিউবওয়েল ও পুকুরের পানি। সেই থেকেই তাদের চলছে খাবার পানির সংকট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা আশাশুনি ও শ্যামনগরের অধিকাংশ এলাকায় খাবার পানির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আইলার পর এলাকার অধিকাংশ টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ত ও আর্সেনিক যুক্ত হওয়ায় উপজেলার অনেক এলাকায় এখন সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই খোলা পুকুর ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (পিএসএফ) বসানো পুকুরের পানি পান করে জীবনধারণ করছেন হাজার হাজার মানুষ।
অন্য বছরের তুলনায় এবার বৃষ্টি কম হওয়ায় পনির স্তর নিচে নেমে গিয়ে সংকট আরও তীব্র করেছে। এদিকে বেসরকারি কয়েকটি সংস্থা সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন করে পিএসএফের মাধ্যমে কিছু এলাকায় খাবার পানির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু চরাঞ্চলের নারীদের মাইলের পর মাইল হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিএম মাছুদুল আলম বলেন, ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের মধ্যে পাঁচটি গ্রামে পানি সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও বাকি দশটি গ্রামে রয়েছে তীব্র সংকট। বিশেষ করে চাঁদনীমুখা গ্রামের মানুষকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে পারিশামারি গ্রাম থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। শুধু তাই নয়, আমার এলাকার অনেকেই ট্রলারে করে কয়রা উপজেলার ঘড়িলাল থেকে পানি সংগ্রহ করে কোনোরকমে জীবনধারণ করছেন। সরকারিভাবে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার জন্য অল্প কিছু ড্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক ও পানি বিশেষজ্ঞ মোহন কুমার মণ্ডল জানান, ভূগর্ভের পানি লবণাক্ত হওয়া এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উপকূলে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। নিজের পরিবারকে অরক্ষিত রেখে এই এলাকার নারীদের ৩-৪ কিলোমিটার দূরে যেতে হয় পানি আনতে।
তিনি বলেন, সুপেয় পানির সংকটের কারণে এই এলাকায় পানিবাহিত রোগ বাড়ছে। বিশেষ করে নারীদের অ্যাকলেমশিয়া এবং জরায়ু সংক্রমণ বাড়ছে তাদের। পানির সংকট নিরসন করতে না পারলে আগামী দিনে এই এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। উপকূলীয় এলাকায় পুকুর খনন করে পন্ডস স্যানিটাইজার স্থাপন করা, বড় বড় জলাধার নির্মাণ এবং বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সেগুলো পানের ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ জুলফিকার আলী রিপন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ঋতু পরিবর্তনের ফলে এ বছর বৃষ্টি কমে যাওয়ায় পানির লেয়ার নিচে নেমে গেছে। তবে এ এলাকায় পানির সংকট দীর্ঘদিনের।
সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার বলেন, আইলার পর এলাকার অধিকাংশ টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ত ও আর্সেনিকযুক্ত। উপজেলার অনেক এলাকায় এখন খাওয়ার পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য এলাকায় ড্রামের ব্যবস্থা করেছি। অনেক এলাকায় ড্রামের স্বল্পতা রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। ড্রাম আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে শিগগিরই প্রস্তাব পাঠানো হবে।