× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সংখ্যালঘু জাতিসত্তার নারীদের অন্য লড়াই

ফারহানা বহ্নি

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:৪৬ এএম

আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৯:০৯ এএম

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

তাঁতের খটখট শব্দে একসময় মুখর থাকত মান্দি গ্রামগুলো। এ গল্প কয়েক যুগ আগের, যখন প্রত্যেকের ঘরেই তাঁতে বোনা কাপড় পাওয়া যেত। ছিল নানা রকম নকশা। প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মিল রেখে এসব নকশার বিভিন্ন নামকরণ করা হতো। এ পোশাকের সঙ্গে মিশে আছে তাদের জীবনযাপন ও ধর্মীয় অনুভূতি। এমনটাই বলছিলেন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের আসকিপাড়ার মেয়ে মিলন চিসিম। বলা হয়ে থাকে, মান্দিদের এই তাঁতের জন্ম হয়েছে এ অঞ্চলেই। পোশাকে একেক কারুকাজের একেক রকম নাম আছে। যেমন, মিমমাং জাংখি বা মৃত্যু আমার সিঁড়ি, গডস আই বা ঈশ্বরের চোখ, বাঙব্লুক বা প্রজাপতি কিংবা মিল্লাম বা তলোয়ারের মতো কোনো অস্ত্র যা নিজের আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়। এমন আরও অসংখ্য নামের নকশা ছিল, যা সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে। 

বিলুপ্তপ্রায় শিল্পটিকে ফিরিয়ে আনতে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অনেক খুঁজে দুজন তাঁতিকে পেয়েছিলেন মিলন চিসিম। প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপকালে নিজের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার গল্প বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব এই নারী। তার ভাষায়, ‘কাজটা এত সহজ ছিল না। ১৯৯৮ সালের দিকে যখন এ শিল্প একেবারেই বিলুপ্ত, মানুষের মাঝেও বিশেষ আগ্রহ ছিল না, তখন আমি কাজটা শুরু করি। কোনো তাঁতি পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খুঁজে দুজন বয়স্ক মানুষ পাওয়া গেলেও তাদের মধ্যে একজন তখন চোখে দেখতে পেতেন না। তাদের তখন এক মাস সময় লেগেছিল একটা কাপড় বুনতে।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি শুরু করেন। এর মধ্যেই যুক্ত হন একটি ক্রাফট সংস্থার সঙ্গে। ক্রাফটের প্রতি প্রবল দুর্বলতা থেকে শুরু করেন ‘ট্রাইবাল ক্রাফট’। নিজেদের তৈরি, তাঁতে বোনা কাপড়, বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিস নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। 

গারো নামে পরিচিত সম্প্রদায়ের অনেকে নিজেদের মান্দি বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাদেরই একজন মিলন চিসিম। তিনি বলেন, ‘আমাদের এত বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে, এটা মানতে পারিনি। কর্মস্থলে আমার ঊর্ধ্বতন ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান। তিনি এক দিন বললেন, মান্দিরা কত সুন্দর কাপড় বুনত, এখন আর নেই। তখন আরও জেদ বেড়ে গেল। বাইরেও এক্সপোর্ট করতে শুরু করলাম। এভাবে বিদেশিদের মধ্যেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে আমাদের এই তাঁতে বোনা কাপড়। আমার বেশিরভাগ ক্রেতাই ছিল এম্বাসির কর্মীরা।’ 

মান্দিরা তাদের হাতে বোনা এ পোশাককে বলেন গান্না খিলতাং ও বাটরেং। গান্না অর্থ পরা, খিলতাং অর্থ খাটো (হাঁটুর নিচ পর্যন্ত বা হাঁটু পর্যন্ত পরা হয় বলে খিলতাং বলা হয়)। আর বাটরেং হলো ওড়না। মান্দিদের বহুল পরিচিত পোশাক ‘দকমান্দা বা দক শাড়ি’। দকমান্দা মূলত ভারতের মান্দি সম্প্রদায় তৈরি করে। দকশাড়ি স্বল্পমূল্যে বাসায় পরার জন্য পাওয়া যায়। অনেকেই নিজেদের দেশের এই কাপড় গান্না খিলতাং সম্পর্কে জানেন না। এর বদলে তারা নির্ভরশীল হয়েছেন ভারত থেকে আসা দকমান্দার ওপর। তবে গান্না খিলতাং ছাড়াও ছিল আরও নানা নামের পোশাক, যেগুলো এখন বিলুপ্ত। 

গান্না খিলতাং ও বাটরেং বিশেষ ধরনের তাঁতে তৈরি হয়। খুঁটি দিয়ে টান টান করে বানানো হয় বলে একে ‘খুন্তা টান’ তাঁত বলে। এ তাঁতের আলাদা কোনো মাপ নেই। সাধারণত লম্বায় ১০০ বা ৫০ ইঞ্চি মাপে এ তাঁত বানানো হয়। গান্না লম্বায় ৪৫ থেকে ২৫ এবং বাটরেং ২৫ থেকে ২০ ইঞ্চি বানানো হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ এই তাঁত টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও এই শিল্প এখন বিলুপ্তপ্রায়। 

সংখ্যালঘু জাতিসত্তার শিল্পগুলো বিলুপ্ত হওয়ার কারণ কী? জানতে চাইলে কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল বলেন, ‘মান্দি ও হাজং জাতির পেশা পরিবর্তনের ধরন নিয়ে একটা মাঠকর্ম করেছিলাম। সেখান থেকে ধারণা করা যায়, উনিশ শতকের শুরুতেও এদেশের মান্দি আর হাজংদের জমি ও সচ্ছলতা ছিল। তবে ওই সময়ের পরে যখন জমিগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল তখন অভাবের চাপে চাকরিসহ অন্য পেশায় যেতে শুরু করেন তারা। এই সময়েই সম্ভবত তাঁতগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। ঝরে পড়তে শুরু করে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অনেক ধরনের ডালপালা।’

মিলন চিসিমের মতোই এই যুগে নিজের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন মধুপুরের বেদুরিয়া গ্রামের মেয়ে মুন নকরেক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে এ পেশায় যুক্ত হন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে হাতে বোনা তাঁত শিল্প নিয়ে ‘আপসান’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেন তিনি। এ তাঁত কিছুটা ফিরে আসলেও তা শুধু বিদেশিদের কাছেই বেশি বিক্রি হতো। অধিক দাম ও প্রচারের অভাবে জনসাধারণের নাগালে বাইরে ছিল এটি। তাই সাধারণ মানুষের কাছে এই তাঁতে বোনা কাপড় পৌঁছে দিতে চান বলে জানান মুন নকরেক। 

কেন এই পেশা বেছে নিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা পোশাকের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল, যা আমাকে সব সময় পীড়া দিত। একটা সময় মনে হলো, আমাদের বিলুপ্তপ্রায় তাঁত শিল্পকে নিয়ে কাজ করা যায়। একদিকে যেমন শিল্পটা রক্ষা হবে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করা যাবে। এ ছাড়া শুধু নিজেদের পোশাক নিয়ে কাজ করা এতটা সহজ নয়। এটা তো শুধু পোশাক নয়, আমাদের অস্তিত্বকে তুলে ধরে, পরিচয় করিয়ে দেয় আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে। প্রতিটা গ্রামে যেন এই তাঁতের কাজ ছড়িয়ে পড়ে, সে চেষ্টাই করছি আমি।’ 

নিজের উত্থানপতন নিয়ে বলতে গিয়ে মুন বলছিলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে প্রথমদিকে অনেক কটুকথা শুনতে হয়েছে। কারণ অনলাইনে এবং পুরোপুরি উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করার প্রবণতা তখন মান্দি সম্প্রদায়ে ছিল না বললেই চলে। সবাই বলত বিসিএস, ব্যাংক জব না করে এগুলো কী করছি। তবে হতাশ হয়ে হাল ছাড়িনি। আমরা নিজেরা যদি কাজ না করি, আমাদের অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’ 

রাঙামাটির মেয়ে ঋতিষা চাকমা জেন্সি। চাকমাদের বিচিত্র সব গয়না প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গয়নার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আদিবাসীদের অনেক ইতিহাস। যেমন আদিবাসী যেকোনো নারীকে পয়সার মালা ছাড়া কল্পনা করা যায় না। ব্রিটিশ আমলে তারা মুদ্রা জমিয়ে মালা বানাত। এখন নকল পয়সা বানিয়ে সেই মালা বানানো হয়। আরও অনেক বাহারি রকমের গয়না আছে আমাদের। ঐতিহ্যবাহী আলছড়া, চন্দ্রহার, কুঁজি হারু (হাতে পেঁচানো চুড়ি), ঠেংঅত হারু (পায়ের চুড়ি) বাজু, হজ ফুলে (কানের দুল) এ নামগুলো হয়তো অনেকে জানেই না। বিয়েতে চাকমা নারীরা পিননের (চাকমাদের পোশাক) সঙ্গে এই গয়নাগুলো পরে।’ 

২০১৭ সাল থেকে গয়না নিয়ে কাজ শুরু করেন ঋতিষা চাকমা। তিনি বলেন, প্রথমে কারিগররা বুঝতেই পারত না কীভাবে করতে হবে। ধীরে ধীরে গয়না নিয়ে গবেষণা করেছি। আমাদের নিজস্ব যে গয়না আছে, সেগুলো নিয়ে কারিগরদের কাছে ছুটেছি। ধীরে ধীরে এসব গয়না এখন অনেকে তৈরি করতে শুরু করেছে। কাজটা আমার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। ঠিকমতো যদি না হয় তাহলে বিতর্কিত হতে হয়। কারিগরদের ঠিকভাবে বোঝাতে হয়, কোনটা কীভাবে হবে, অন্যদিকে কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী গয়নাগুলো তৈরি করে দিতে হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন ও মানবাধিকার নিয়ে স্নাতকোত্তর শেষে ‘তারেঙ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেন ত্রিশিলা চাকমা। টি-শার্টে রং-তুলি দিয়ে নিজেদের জীবনযাপনের নানা চিত্র তুলে ধরেন তিনি। তার ভাষায়, ‘উচ্চশিক্ষায় ঢাকা থাকাকালে বুঝতে পারি, আমরা বাংলাদেশি হলেও অন্য জেলার মানুষ আমাদের সম্পর্কে খুব অল্প জানে। প্রায় সময় শুনতে হয় আমরা বিদেশি কি না। রাস্তায় হেঁটে গেলে চাইনিজ চুংচাং বলে ডেকে যায়। অথচ আমরা নিজেরা জানি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সংস্কৃতি কত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। মূলত আমাদের সংস্কৃতিকে সবার মাঝে সঠিক তথ্য নিয়ে উপস্থাপন করতেই তারেঙের যাত্রা শুরু করি।’ 

ত্রিশিলা চাকমা বলেন, ‘তারেঙ একটি চাকমা শব্দ, যার অর্থ পাহাড়ের ঢালুর অংশ। যাতে চড়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা যায়। আমরাও সেই চূড়ায় উঠতে চাই। টি-শার্ট হচ্ছে সবার জন্য আরামদায়ক একটি পোশাক, যা ছোটবড় সবাই পরে। আমাদের মনে হয়েছে এর মাধ্যমে আমরা দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছতে পারব।’ 

তিনি বলেন, নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পণ্য নিয়ে কাজ করা আসলে খুব চ্যালেঞ্জিং। এর প্রথম বাধা হচ্ছে সংস্কৃতিগত পার্থক্য, আর আমাদের এলাকায় কাঁচামালের অভাব। 

মণিপুরি ভাষায় জুলাই মাসকে ইঙেল বলে আর লেই হচ্ছে ফুল। জুলাই মাসে এই ফুলের দেখা পাওয়া যায়। এ মাসে শুরু করায় দুটো মিলিয়ে অনলাইন দোকানের নাম রেখেছেন ইঙেলৈ। মণিপুরি শাড়ি সব সম্প্রদায়ের কাছে পরিচিত হলেও ঐতিহ্যবাহী পোশাক ফানেক-ইনাফির সঙ্গে সবাই পরিচিত না। ফানেক নারীরা কোমরে পেঁচিয়ে পরে। ইনাফি হলো ওড়না। এ পোশাককে সবার সামনে তুলে ধরতে চান সিলেট শহরের আম্বরখানার মেয়ে খাইদেম সিথি সিনহা। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর শেষে ২০২০ সালে শুরু করেন এ কাজ। সিথি বলেন, আমি নিজেও আমাদের অনেক কিছু জানতাম না। আমি শুধু যে আমাদের পোশাক, গামছাÑ এসব বিক্রি করি তা-ই নয়। সেসবের সঙ্গে জড়িত আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের কথাও বলি। মানুষও পরে, আমাকে উৎসাহ দেয়।

এ ধরনের কাজে পুরুষের তুলনায় নারীরাই বেশি সক্রিয়। এ বিষয়ে ত্রিশিলা চাকমা বলেন, আমাদের ব্যবসার কাজের ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ের অংশগ্রহণ সমানভাবেই আছে। তবে তাঁতের বুননের কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি। এ ছাড়া পার্বত্য এলাকায় সব ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি। কিন্তু সে তুলনায় তাদের মূল্যায়ন হয় না। 

বাংলাদেশের আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা বলেন, আদিবাসী নারীরা শহরমুখী হলেই শুধু ঐতিহ্য রক্ষায় বড় ভূমিকা রেখেছে তা নয়। পাহাড়ে বা সমতলে গিয়ে তাদের দেখলেই বোঝা যাবে একই সঙ্গে কৃষিকাজ ও পরিবারে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছে তারা।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা