ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৫ ১২:২৫ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
দুপুর ২টা। রাজধানীর হাজারীবাগের ঢাকা ট্যানারি মোড়ের একটি দোকানে বসে ছিলেন বিক্রেতা মোহাম্মদ ওয়াসিম। দোকানের তাকে তাকে সাজানো নানা আকার ও রঙের চামড়ার জুতা, বেল্ট, ব্যাগ। প্রতিষ্ঠানটি জাপান ও চীনে কয়েক বছর যাবৎ পাদুকা বা জুতাসহ চামড়াজাতীয় পণ্য রপ্তানি করে সাফল্য পেয়েছে। প্রতিবছর তাদের রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। বিশেষ করে চামড়ার জুতা রপ্তানি তাদের প্রধান পণ্য।
এ ব্যাপারে মোহাম্মদ ওয়াসিম বলেন, জাপান থেকে অর্ডার পাই। সে অনুযায়ী জুতা তৈরি করে রপ্তানি করছি। চীন থেকেও অর্ডার আসে। তবে সবচেয়ে বেশি অর্ডার আসে জাপান থেকে। অর্ডারের পণ্য বানানোর পর বেঁচে যাওয়া চামড়া দিয়ে জুতা, লেডিস ব্যাগ, খেলনা, প্যান্টের বেল্টসহ অন্যান্য পণ্য তৈরি করে দেশীয় বাজারে সরবরাহ করছি। এতে করে কোনো চামড়া নষ্ট হয় না। ব্যয়ের মূল টাকাটা রপ্তানি থেকে আসে। আর অতিরিক্ত টাকা আয় হয় বেঁচে যাওয়া চামড়া কাজে লাগিয়ে পণ্য তৈরি করে।
দেশীয় বাজারে লেডিস জুতা ৯৫০ থেকে ১ হাজার ৭৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। জেন্টস জুতা ১ হাজার ২৫০ থেকে ৪ হাজার ৫০ টাকা, ব্যাগ মানিব্যাগ ৬৫০ থেকে ১ হাজার ৬৫০ টাকা, ওয়ালেট ৬৫০ থেকে ১ হাজার ২০০, লেডিস ওয়ালেট ১ হাজার ৬৫০ থেকে ৫ হাজার, বেল্ট ৬৫০ থেকে ১ হাজার ২৫০। ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট ৯ হাজার ও গরুর চামড়ার জ্যাকেট ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তিনি বলেন, বেঁচে যাওয়া চামড়া থেকে বছরে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা বিক্রি করা সম্ভব হয়।
চীন থেকে কৃত্রিম আর্টিফিশিয়াল জুতা আমদানি বাড়ায় চামড়ার জুতার বাজারে বিক্রি কমেছে বলেও জানান তিনি। বলেন, বাচ্চাদের থেকে শুরু করে জেন্টস স্যান্ডেল, স্লিপার, শু, ক্যাজুয়াল, ফরমাল, হাই নেকসহ বিভিন্ন প্রকারের জুতা তৈরি করা হয়।
চলতি অর্থবছরে জুতা রপ্তানি বেড়েছে
দেশে যে পরিমাণ চামড়া উৎপাদন হয় তার মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ দেশীয় বাজারে ব্যবহার হয়। বাকি ৭৫ শতাংশ বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। আর এর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে বাংলাদেশের চামড়ার জুতার বেশিরভাগই ইউরোপের অস্ট্রিয়া, সাইপ্রাস, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিল, চিলিসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। তা ছাড়া চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাতেও চামড়া, রাবার ও প্লাস্টিকের জুতা রপ্তানি হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চামড়ার জুতা রপ্তানি বেড়েছে ২৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এই সাত মাসে জুতা রপ্তানি হয়েছে ৪০৩ দশমিক ৩৬ ডলার। যা আগের বছরের একই সময় ছিল ৩২৫ দশমিক ৩১ ডলার। শুধু জানুয়ারি মাসে রপ্তানি হয়েছে ৫০ দশমিক ৭১ ডলার। তবে মাস হিসাবে গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৫৫ দশমিক ৭১ ডলার। এদিকে বছরের হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৪ কোটি ৪০ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৯ দশমিক ২৭ ডলার রপ্তানি হয়েছে। তার আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৬৯ কোটি ৩২ লাখ ১৫ হাজার ২৬ দশমিক ৮৯ ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে রপ্তানি ছিল ৩০ কোটি ৫১ লাখ ১২ হাজার ৯১৬ দশমিক ৯৬ ডলার।
জুতা রপ্তানিতে করতে হয় চামড়া আমদানি
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার দেশগুলোতে জুতা রপ্তানি করতে হলে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদপ্রাপ্ত কারখানার চামড়া ব্যবহার করতে হয়। এতে করে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি চামড়া আমদানি করে থাকে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মুত্তালিব বলেন, চামড়া শিল্প কী ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করছে সে সম্পর্কে মালিকপক্ষ আমাদের কাছে আসে না। এতে করে আমরা জানি না তারা কোন কোন সমস্যায় ভুগছে। তারা যদি আসত তাহলে ইনস্টিটিউট, মালিকপক্ষ ও সরকার মিলে এসব সমস্যার সমাধান করা যেত।
তিনি বলেন, ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা রপ্তানি করতে হলে সাভারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (সিইটিপি) মেরামত করে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। কেননা উন্নত দেশগুলোতে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা রপ্তানি করতে হলে এলডব্লিউজির সনদপ্রাপ্ত কারখানার চামড়া ব্যবহার করার শর্ত আরোপ করে থাকে। আমাদের দেশে বিপুল পরিমাণ চামড়া আছে কিন্তু সনদপ্রাপ্ত কারখানা মাত্র ৬টি। তাই বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে বেশি দামে চামড়া আমদানি করে অর্ডার পূরণ করতে হয়। চীন আমাদের দেশ থেকে কমদামে ক্রাস্ট চামড়া কিনে নিয়ে ফিনিশড করে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে রপ্তানি করছে বলে উল্লেখ করে ড. মো. আব্দুল মুত্তালিব বলেন, চামড়া তৈরি করতে যত বর্জ্য হয় তার ৯০-৯৫ শতাংশ ক্রাস্ট পর্যায় পর্যন্ত হয়। চীন সেসব চামড়া কিনে নিয়ে ওপরে শুধু ফিনিশ করে আমাদের দেশে রপ্তানি করে। চীন ৫ থেকে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত কাজ করে এসব টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এলডব্লিউজি সনদ কী
চামড়াজাত পণ্য ব্যবহারের জন্য ২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস, টিম্বারল্যান্ডসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড একসঙ্গে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো পরিবেশ সুরক্ষা করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করতে হবে। বিশ্বে বর্তমানে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এটির সদস্য।
এলডব্লিউজি সনদ দিতে কারখানাগুলো নিরীক্ষা করে পরিবেশগত মানদণ্ড অনুযায়ী চার শ্রেণিতে সনদ দেওয়া হয়। তার মধ্যে রয়েছে গোল্ড, সিলভার, ব্রোঞ্জ এবং সাধারণ। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি ও পানির দক্ষ ব্যবহার, কাঁচামালের উৎস ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে থাকে।
বর্তমানে বাংলাদেশে আড়াই শতাধিক নিবন্ধিত ট্যানারি আছে। তার মধ্যে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে কারখানা স্থাপন করেছে ১৪৯টি। এসবের মধ্যে মাত্র ৬টি ট্যানারি এলডব্লিউজির সনদ পেয়েছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এলডব্লিউজির সনদপ্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা ১৩৯টি, চীনে ১০৩, ইতালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০টি।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মুত্তালিব বলেন, ভারতের ট্যানারি আমাদের পর কার্যক্রম শুরু করে তারা কোথায় চলে গেছে। আর আমরা পিছনে পড়ে আছি। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেকগুলো মাল্টিন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে। তারা বাইরে থেকে চামড়া কিনে এনে জুতা তৈরি করে রপ্তানি করছে।
ব্যক্তিগতভাবে ইটিপি করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বড় কোম্পানিগুলো নিজেরা ইটিপি তৈরি করবে। কয়েকটি কোম্পানি মিলেও করতে পারে। তা ছাড়া যাদের সামর্থ্য নেই শুধু সেইসব কোম্পানি সিইটিপি ব্যবহার করবেÑ এমন ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলে বিশ্বে জুতাসহ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে ভালো বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব।
জুতার বৈশ্বিক বাজার চীনের কব্জায়
বিশ্বে অন্যান্য পণ্যের বাজারের মতো জুতা বা পাদুকা শিল্পের বাজারও চীনের কব্জায়। দেশটি বিশ্বের ৫৫ শতাংশ জুতা উৎপাদন করে থাকে। পর্তুগিজ ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের এপিআইসিসিএপিএস দ্বারা প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার ইয়ারবুক ২০২৩’-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ওশেনিয়া মহাদেশ ছাড়া বাকি ৫টি মহাদেশে জুতা উৎপাদন করা হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জুতা উৎপাদন হয় এশিয়ায় ৮৭.১ শতাংশ। তার পরের স্থানে রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা ৫.২, আফ্রিকা ৩.৪, ইউরোপ ২.৮ ও উত্তর আমেরিকা ১.৫ শতাংশ।
শুধু যে জুতা উৎপাদনে এগিয়ে বিষয়টি তা নয় বরং জুতা ব্যবহারের দিক দিয়েও বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার ইয়ারবুক ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, চীনে বছরে ৩ হাজার ৫৩২ মিলিয়ন জোড়া জুতা ব্যবহার হয়, যা বিশ্বের ১৭.১ শতাংশ। ভারতে ব্যবহার হয় ২ হাজার ৫৬৩ মিলিয়ন জোড়া, বিশ্বের ১২.১ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৯৩৪ মিলিয়ন জোড়া, বিশ্বের ৯.৪ শতাংশ। ব্রাজিলে ৭৭৬ মিলিয়ন জোড়া, বিশ্বের ৩.৮ শতাংশ। জাপানে ৬১৬ মিলিয়ন জোড়া, বিশ্বের ৩.০ শতাংশ। পাকিস্তানে ৫৪৪ মিলিয়ন জোড়া, বিশ্বের ২.৬ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ায় ৫৪৪ মিলিয়ন জোড়া, বিশ্বের ২.৬ শতাংশ। রাশিয়ায় ৪২৮ মিলিয়ন জোড়া, বিশ্বের ২.১ শতাংশ। বাংলাদেশে ৩৫৫ মিলিয়ন জোড়া, বিশ্বের ১.৭ শতাংশ এবং মেক্সিকোতে ৩৪০ মিলিয়ন জোড়া, যা বিশ্বের ১.৬ শতাংশ।
এদিকে বিশ্বব্যাপী জুতার উৎপাদন কমেছে। এতে করে কমেছে রপ্তানি বাজারও। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক জুতা উৎপাদন ৬ শতাংশ কমে ২২.৪ বিলিয়ন জোড়া হয়েছে, যা ২০২০ এবং ২০২১ সালের করোনা মহামারির বছরগুলো বাদ দিয়ে গত এক দশকে সর্বনিম্ন। ২০২২ সালে এশিয়াতে জুতার উৎপাদন ছিল ৮৭.৪ শতাংশ ও ২০২৩ সালে ছিল ৮৭.১ শতাংশ। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী ১২.৩ বিলিয়ন জোড়া জুতা উৎপাদিত হয়েছে সেখানে চীন একাই ৫৫ শতাংশ উৎপাদন করে বিশ্ববাজার দখলে রেখেছে। ভারতও উৎপাদন বাড়িয়েছে।
২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী জুতা রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৪ বিলিয়ন জোড়া, যার আর্থিক মূল্য ১৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাপী জুতা রপ্তানির তিন-চতুর্থাংশের বেশি অংশ দখলে রেখেছে চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া। সেখানে চীন মোট রপ্তানির ৬৩.৮ শতাংশ, ভিয়েতনাম ৯.৫ এবং ইন্দোনেশিয়া ৩.২ শতাংশ রপ্তানি করছে। আশার কথা হচ্ছেÑ বছরটিতে জুতার উৎপাদন ও রপ্তানি কমলে বাড়ে দাম। প্রতি জোড়া জুতা রপ্তানির গড় মূল্য বেড়ে ১২ মার্কিন ডলার হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩.২ শতাংশ বেশি।