রাহাত হুসাইন
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৫ ০৯:৫২ এএম
ফাইল ফটো
ঋতুতে চলছে বসন্ত; কিন্তু এখনও সন্ধ্যায়-রাতে রাজধানীবাসীকে জ্বালাচ্ছে কিউলেক্স মশা। মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে শহরের বেশকিছু অঞ্চলের অধিবাসী। মশার কামড় থেকে বাঁচতে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করেও রেহাই পাচ্ছে না। কয়েল, স্প্রে, মশারি কিংবা ইলেকট্রনিক ব্যাট দিয়ে মশা মারার চেষ্টাও বিফলে যাচ্ছে। অথচ বর্ষা-শীত পেরোনো এই সময়ে অন্তত মশার উপদ্রব থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার কথা তাদের। মূলত দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলতার অভাবেই এমন অবস্থা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বয় নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। পৃথক পৃথক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সংস্থা দুটি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ক্ষুদ্রাংশে ফগিং করছে। এতে এক এলাকার মশা দ্রুত উড়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছে। বৃহৎ পরিসরে মশা নির্মূলে কোনো কাজ হচ্ছে না। যে কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করার নিজস্ব ব্যবস্থা নেই তাদের কাছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর জুরাইন, শ্যামপুর, ধলপুর, কতমতলী, ধোলাইপাড়, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, বাসাব, বাড্ডা, উত্তরার দক্ষিণখান, উত্তরখান, নাখালপাড়া, মিরপুরের লালমাটিয়া, চলন্তিকা বস্তি, দুয়ারীপাড়া, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ধ্যার পর মশার উপদ্রব বাড়ে। ঘরে-বাইরে জ্বালায় মশা। মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কার্যকর উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ নগরবাসীর। তারা বলছেন, সিটি করপোরেশন নিয়মিত ওষুধ ছিটাচ্ছে না। যে ওষুধ দিচ্ছে তাতে মশা মরে না। ফগিং করার সময় এক জায়গা থেকে মশা অন্য জায়গায় চলে যায়।
ধোলাইরপাড়ের ১ নম্বর গলির মুখে চায়ের দোকানি আব্দুল বাতেন জানান, মশার জ্বালায় দোকান করতে অসুবিধা হচ্ছে। দোকানে বসে কাস্টমাররা চা-বিস্কুট খেতে পারছেন না। মশা খুব বিরক্ত করে। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, সন্ধ্যা হলে মশার কামড়ে দোকানে বসে থাকতে কষ্ট হয়। আগে সিটি করপোরেশনের লোকজন ধোঁয়া (ফগার মেশিনের মাধ্যমে ওষুধ ছিটানো) দিত। তাতে মশা মরে না, তবে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যেত। এখন সেটা করা হয় না। অভিযোগের সুরে একই কথা বললেন রাজধানীর নন্দীপাড়া বড় বটতলার স্থানীয় বাসিন্দা ওবায়দুল্লাহ। তার বাসার কয়েক কদম দূরেই জিরানী খাল। তিনি একজন টেলিকম ব্যবসায়ী। ওবায়দুল্লাহ বলেন, শীতের পর থেকেই বাসাবর নন্দীপাড়ায় মশা বেড়েছে। মশার জ্বালায় বাসায় থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। দোকানেও বসে থাকতে পারি না। দীর্ঘদিন ধরে আমার এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হয় না। আর খালটিও পরিষ্কার করা হয় না অনেকদিন।
এদিকে এবার শীত শেষ হতেই বাড়ছে তাপমাত্রা। এমন তাপমাত্রা মশার বংশবৃদ্ধির জন্য সহায়ক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে মশাও বেড়েছে। নালা-নর্দমার অপরিচ্ছন্ন, সেগুলোতে পানি জমে থাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে মশার বৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। মশা নিয়ন্ত্রণে টেকসই উদ্যোগ নিতে হবে। মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে, নিয়মিত ফগিং ও লার্ভিসাইড প্রয়োগ করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়া শীতের শেষে হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মশার বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, মশার উৎপাদন হয় জলাবদ্ধ পানি থেকে। ঢাকার নালা-নর্দমায় এখন পানি জমে আছে। এটা মশা বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও রয়েছে। বদ্ধ পানির স্থায়ী সমাধান করতে হবে। কোথায়ও যেন পানি জমে না থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
সিটি করপোরেশনের কর্মীদের মাসে একবারও চোখে পড়ে না জানিয়ে দক্ষিণখানের ৪৮ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইয়াসিন রানা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের এলাকায় মশার উৎপাত অনেক বেশি। মশক নিধনকর্মীদের মাসে একবারও চোখে পড়েনি। মশা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা কাজ করছে। তারা সিটি করপোরেশনের ওপর বেজায় নাখোশ। কাউন্সিলর না থাকায় মশা নিয়ে কারও সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না।
উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা এসএম শামীম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, সন্ধ্যার পর ঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখলে মশার উপদ্রব বাড়ে। এজন্য মশার কয়েল জ্বালিয়ে রাখি।
বাংলাদেশ কীটতত্ত্ব সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. রুহুল আমিন বলেন, এবার শৈত্যপ্রবাহ কম থাকায় আগেভাগেই মশা বেড়ে গেছে। মশার বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা সাধারণত ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। এই তাপমাত্রায় মশার ডিম, লার্ভা ও পিউপা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পূর্ণাঙ্গ মশা জন্ম নেয়। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কীটতত্ত্ববিদ সেল থাকা দরকার। মশা নিধনে তাদের কোনো গবেষণা নেই। তাদের পরামর্শ নিয়ে মশার উপদ্রব কমাতে ব্যবস্থা নিলে ভালো হতো। তারা যে কীটনাশক ব্যবহার করে তাতে কার্যকর উপাদানগুলো আছে কি না তা পরীক্ষা করার কোনো ল্যাব নেই; জনবলও নেই। মশার হাত থেকে নগরবাসীর দুর্ভোগ কমাতে সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করতে হবে।
তবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেছেন ভিন্ন কথা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নূর হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বছরের এ সময় কিউলেক্স মশার উৎপাত বেশি থাকে। এ সময়টাতে নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে লার্ভিসাইডিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি ফগিং কার্যক্রম নিয়মিত চলছে। কিউলেক্স মশার প্রধান প্রজননকেন্দ্র হচ্ছে ডোবা, নালা, নর্দমা, জলাশয়। এগুলো পরিষ্কার করে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।
মশা নিধনে উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে দক্ষিণের কোনো সমন্বয় না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আলাদা প্রতিষ্ঠান। আমরা আমাদের নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা অনুসারে কাজ করছি। মশককর্মীরা যাতে সার্বক্ষণিক কাজ করেন, সেজন্য কেন্দ্রীয় কন্ট্রোলরুম থেকে মনিটরিং করা হয়। একটি এলাকায় প্রতিদিন মশা মারার ওষুধ ছিটানো হলে সেটা প্রাণিজ পরিবেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। এজন্য আমরা সচরাচর তিন দিন পরপর একেকটা এলাকায় ওষুধ দিয়ে থাকি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, মশা নিধন সিটি করপোরেশনের একটি বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে পুরোপুরি মশা নিধন সম্ভব নয়। এর জন্য জনগণের সহযোগিতা ও সচেতনতাও প্রয়োজন। আমাদের কর্মীরা নিয়মিত মশার ওষুধ দিচ্ছেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তবুও মশা নিয়ন্ত্রণে নেই। কারণ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কর্মীরা বিভিন্ন বাসাবাড়িতে প্রবেশ করতে পারেন না। নিরাপত্তার কারণে কর্মীদের বিল্ডিংয়ে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আমরা অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি, দুই বাড়ির মাঝখানের জানালা দিয়ে ময়লা ফেলা হচ্ছে। বাড়ির গেটের ভেতরে জানালা দিয়ে ময়লা ফেলছে। যেগুলো আমাদের কর্মীরা পরিষ্কার করতে পারেন না। মশককর্মীরা সেসব জায়গায় লার্ভিসাইডিং করতে পারেন না। ফলে বাসাবাড়ির ভেতরেই মশা উৎপাদন হচ্ছে। অবশ্যই নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। নিজেদের বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।