সুরমা জাহিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৫৯ এএম
সুরমা জাহিদ
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষী মানুষের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ দিনটি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
শহীদদের আত্মত্যাগের একটি মহান স্বীকৃতি বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। বাঙালি জাতির একটি চেতনা, প্রেরণা এবং গভীর শ্রদ্ধার দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। যারা আমাদের মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের মাধ্যমে উৎসর্গ করেছেন জীবন তাদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে তুর্কি-আফগান শাসনকালে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি লোকগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। মোগল যুগে এই প্রক্রিয়ায় একটা ছেদ পড়ে। মোগল শাসকরা ভাষা ও সংস্কৃতির চেয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও বিধি ব্যবস্থাগুলো বিকাশে বেশি মনোযোগী হয়। এতদসত্ত্বেও এই সময়েও বাংলা সংস্কৃতির প্রসার ও উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে রোসাং, কাছাড়, ত্রিপুরা, কুচবিহার, সিলেট এবং মল্লভূমে এই উন্নয়ন লক্ষণীয়। এই সময়কালে দুই প্রধান মুসলিম কবি দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজসভার সভাকবি ছিলেন।
মধ্যযুগে বাংলা কাব্য সাহিত্যের বিকাশ সম্পর্কে এক চমৎকার ও নিটোল বর্ণনা পাওয়া যায় মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখা ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, কাব্যের প্রাচীনতম লিখিত নিদর্শন মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’ (১৩৮৯-১৪১০), না বডু চন্ডীদাসের (১৪১৭-৭৭) ‘শ্রী কৃষ্ণকীর্তন’Ñ এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। পনেরো শতকের শেষার্ধে রচিত হলো কৃত্তিবাসের কালজয়ী রামায়ণ। ‘রসুল বিজয়ের’ কবি মৈনুদ্দিন ও ‘শ্রী কৃষ্ণ বিজয়ের’ কবি মালাধর বসু, যিনিই যার দ্বারা প্রভাবান্বিত হোন না কেন তারা এক নতুন ধারার প্রবর্তন করলেন। অনুসারী অনুকারদের হাতে এক ‘বিজয়’ সিরিজ বের হতে শুরু করল ‘মনসাবিজয়’ ‘গোপাল বিজয়’ ইত্যাদি। একটা নতুন পথের দিশা পেলেই এখানে এক গড্ডলিকা প্রবাহের সৃষ্টি হয়। পনেরো শতকে শুরু হলো আরও এক সিরিজের, মঙ্গলকাব্যের ধুম পড়ে গেল। ‘গৌরীমঙ্গল’, ‘মনসামঙ্গল’, ‘চন্দ্রমঙ্গল’, ‘কালিকামঙ্গল’, ‘সারাদামঙ্গল’, ‘দুর্গামঙ্গল’, ইত্যাদি শেষ হলো অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলে’। চৈতন্যের অভ্যুদয়ের পর বাংলা সাহিত্যে এলো আর এক জোয়ার। এর প্রভাব ছিল ব্যাপক। বেশ কিছু মুসলিম কবিও পদাবলী রচনা করেছেন। ‘মহাভারতের’ অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর দাস ও শ্রীকর নন্দীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ষোলো শতক থেকে ত্রিংশাধিক কবি মহাভারতের পূর্ণ বা আংশিক অনুবাদ করেছেন। সতেরো শতকে রচিত হলো কাশীরাম দাসের ‘মহাভারতের’ অমৃত বচন।
বাংলা হরফে মুদ্রিত প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ (১৮০১) হলো রাম রাম বসু প্রণীত রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র। উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে সৃজনশীলতার জোয়ার শুরু হয়। অনেক দাবি করেছেন, উনিশ শতকে একটি রেনেসাঁ সূচিত হয়েছিল।
বিশ শতকের তৃতীয় দশকে বাংলা সাহিত্য ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এ সময় জনগণ, দেশ, সমাজ, রাজনীতি সাহিত্যের উপজীব্যে পরিণত হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তিলগ্নেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অমূল্য ঐশ্বর্যসম্ভারে ঐশ্বর্যময়ী হয়ে উঠেছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বসভায় গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত। একটি ভাষা উৎকর্ষ অর্জনের মধ্য দিয়ে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে পরিণত হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় পূর্ববাংলার বাংলাভাষী ৪ কোটি ৪০ লাখ জনগণ তৎকালীন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অংশ হয়ে যায়। করাচিতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে শুধু উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা এবং স্কুল ও মিডিয়াতে ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে এর প্রতিবাদ হয়ে যায়। ঢাকায় ছাত্রগণ তমদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা আবুল কাসেমের নেতৃত্বে র্যালি বের করে। বৈঠকে বাংলাকে পাকিস্তানের একটি সরকারি ভাষা এবং পূর্ববাংলার শিক্ষার মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয় এবং একই সঙ্গে মুদ্রার নোট এবং স্ট্যাম্প থেকে বাংলা মুছে ফেলা হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। এতে বাঙালি জনগণ বিক্ষুব্ধ হয় এবং ছাত্রদের একটি বড় অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে একটি সরকারি ভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জমায়েত হয়। এজন্য ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে। তারই সূত্র ধরে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়।
১৯৪৮ সালের মার্চে সীমিত পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। অতঃপর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন : ‘Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan.’ এর তিন দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোর দিয়ে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয়-অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেননি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) শুধু উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে, বাঙালি ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সকাল ৯টায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করে। বেলা সোয়া ১১টার দিকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা করে। ছাত্রদের একটি দল ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড় দেয় এবং বাকিরা পুলিশ পরিবেষ্টিত ক্যাম্পাসে মিছিল করে। উপাচার্য পুলিশকে গুলি চালানো বন্ধ করতে এবং ছাত্রদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। ছাত্রদের চলে যাওয়ার সময় ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের জন্য পুলিশ কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের সংবাদ পেয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পূর্ব বাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে সেখানে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপনের দাবি জানায়। আন্দোলনরত বাঙালি ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে অনেক তরুণ ছাত্র শহীদ হন। যাদের মধ্যে রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে রয়েছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে কানাডার ভ্যাংকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন। সে সময় সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি রফিকুল ইসলামকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের কারও কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। পরে রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালামকে সঙ্গে নিয়ে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজিভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারও কফি আনানকে ‘এ গ্রপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অব দ্য ওয়াল্ড’-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন এবং চিঠির একটি কপি ইউএনও’র কানাডীয় দূত ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করা হয়।
১৯৯৯ সালে তারা জোশেফের সঙ্গে ও পরে ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সঙ্গে দেখা করেন, আনা মারিয়া পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫টি সদস্য দেশÑ কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে। তারপর বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দানে ২৯টি দেশ অনুরোধ জানাতে কাজ করেন।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ও এতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোয় যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।
২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে ‘এখন থেকে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ’ এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। মে মাসে ১৩৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্য বিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।
এত নিষ্ঠুর অবর্ণনীয় অমানবিক নির্যাতন সহ্য করে পাওয়া একুশের চেতনাকে লালন করে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাব, এই প্রত্যাশায়।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক