× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর : পাহাড়ে শান্তি কতদূর

বিশেষ প্রতিনিধি, রাঙামাটি থেকে ফিরে

প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:১৫ এএম

আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:৩৬ পিএম

পার্বত্য শান্তি চুক্তি সই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমা। ছবি : সংগৃহীত

পার্বত্য শান্তি চুক্তি সই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ও সন্তু লারমা। ছবি : সংগৃহীত

গত ২৫ বছরে অনেক জল গড়িয়েছে কাপ্তাই লেক, সাঙ্গু কিংবা চেঙ্গি নদীতে। অনেক পরিবর্তনও এসেছে দেশের পার্বত্য তিন জেলার জনজীবনে। কিন্তু সার্বিক অর্থে শান্তি কি ফিরেছে? পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আড়াই দশক পর প্রতিদিনের বাংলাদেশ সরেজমিনে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। জানতে চেয়েছে মানুষের প্রত্যাশা কতটুকু ছিল, আর কতটুকুই বা পেয়েছে তারা।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় আড়াই দশকের সশস্ত্র সংঘাতের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নামে স্বাক্ষরিত হয় এক ঐতিহাসিক চুক্তি। যে চুক্তিটি পার্বত্য শান্তিচুক্তি হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। কোনো তৃতীয় পক্ষের সমঝোতা ছাড়াই চুক্তির প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষে সংগঠনের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা। 

তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই চুক্তিতে ছিল ৭২টি ধারা। যার মধ্যে ৭০টি বাস্তবায়ন করবে সরকার আর ২টি জনসংহতি সমিতি। সরকারি তথ্য অনুসারে গত ২৫ বছরে পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে ১৫টি এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুসারে ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করতে ভূমি কমিশন গঠন, প্রত্যাগত ১২ হাজার ১২৩টি পরিবারকে পুনর্বাসন, একটি পদাতিক ব্রিগেড ও নিরাপত্তা বাহিনীর ২৪১টি ক্যাম্প প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। 

চুক্তির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা গত কয়েক বছর যাবৎই ২ ডিসেম্বর প্রকাশ্য আলোচনায় আসছেন। এর আগের প্রতিটি আলোচনায় তিনি দাবি করেছেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার কথা রাখেনি। ফলে পাহাড়ি জনগণ এখন পর্যন্ত প্রত্যাশা অনুযায়ী শান্তিচুক্তির সুফল পায়নি। তার দাবি অনুযায়ী, সরকার চুক্তির মাত্র ২৫টি ধারা সম্পূর্ণভাবে এবং ১৮টি আংশিক বাস্তবায়ন করেছে। আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তিনি। 

১৯৯৮ সালের ১০ ফ্রেব্রুয়ারি জনসংহতি সমিতি নেতা সন্তু লারমা তার সহযোগীদেরসহ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করলেও তাদের কাছে থাকা সব অস্ত্র এখনও জমা হয়নি বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুসারে হস্তান্তর করা হয়নি অস্ত্রধারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও। অভিযোগ রয়েছে, অস্ত্র সমর্পণের নামে জমা দেওয়া হয়েছে পুরোনো এবং অকেজো সব অস্ত্র। গহিন পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের হাতে আছে অনেক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তার কিছু ধরাও পড়েছে। পাহাড়ি অস্ত্রধারীদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মৌলবাদী জঙ্গিরাও। পাহাড়ে তাদের প্রশিক্ষণের খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। এ নিয়ে বান্দরবানে চলছে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান। 

জনসংহতি সমিতির একটি অংশ শুরু থেকেই চুক্তির বিরোধিতা করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। তখনই গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। পাহাড়ে এখন অস্ত্রধারীরা ৬টি দলসহ বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে-ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ (ডেমোক্র্যাটস), জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (রিফর্মিস্টস), কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এবং মগ ন্যাশনাল পার্টি (এমএনএফ)। নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করছেন, সবগুলো গ্রুপই কোনো না কোনোভাবে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তবে জনসংহতি সমিতি বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। 

গহিন পাহাড়ে আস্তানা গেড়ে অস্ত্রধারীরা এখন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কী পরিমাণ চাঁদাবাজি করছে সেটা কিন্তু পার্বত্য জেলা শহরগুলোতে গেলে টের পাওয়া যাবে না। যেতে হবে আরও একটু ভেতরে। রাঙামাটির অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র শুভলং বাজার ঘুরে সেই চিত্র পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে ১৩৭টি দোকান। গহিন পাহাড় থেকে নানাবিধ পণ্য আসে এই বাজারে। জানা গেল, একছড়ি কলা কিংবা একটি মুরগি বিক্রি করতে হলেও পাহাড়ি বাঙালি নির্বিশেষে সবাইকে নির্দিষ্ট পরিমাণে চাঁদা দিতে হয়। যেকোনো পণ্যের বিক্রয় মূল্যের ১০ শতাংশ না দিলে চলে নির্যাতন। এ ব্যাপারে শুভলং বাজার কমিটির সভাপতি আবুল কালাম জানান, পাহাড়ে শান্তিচুক্তির ফলে গত ২৫ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও বর্তমানে বড় সমস্যা হচ্ছে চাঁদাবাজি। অবস্থা এমন যে একটা মুরগি বিক্রি করলেও নির্দিষ্ট একটা অঙ্কের চাঁদা সন্ত্রাসীদের দিয়ে দিতে হয়। 

স্থানীয় গ্রামের প্রধান কারবারি মন্টু বিকাশ চাকমা বলেন, এখানে ব্যবসা করার জন্য তিন-চারটি গ্রুপকে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। 

স্থানীয় আদিবাসী এবং সাবেক ইউপি সদস্য শক্তিমোহন চাকমা বলেন, আগে ছিল এক দল, আর এখন অনেক। ওদেরকে চাঁদা না দিলে এলাকায় বসবাস করা যায় না। 

পাবর্ত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সভাপতি ও বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. মুজিবুর রহমান জানান, ছয়টি উগ্রপন্থি সশস্ত্র গ্রুপ শুধুমাত্র এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই চাঁদাবাজি করছে না, বরং তারা সরকারের প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প থেকেও নির্দিষ্ট হারে কমিশন নিচ্ছে। এই সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে চাঁদা না দিয়ে এ অঞ্চলের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজই করতে পারছে না ঠিকাদাররা। তিনি আরও বলেন, এই সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কারণে শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পরও পার্বত্য তিন জেলায় ভয়ের পরিবেশ বিরাজমান আছে। 

নীরবে চাঁদাবাজি হয় পর্যটন এলাকা সাজেকেও। ছোট্ট এই জনপদের দোকান এবং হোটেলগুলো থেকে প্রতিমাসে ২৫ থেকে ২৬ লাখ টাকা চাঁদা যায় অস্ত্রধারীদের হাতে। ক্যামেরার সামনে অবশ্য এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি ব্যবসায়ীদের কেউ। 

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, তিন পার্বত্য জেলা থেকে বছরে চাঁদা তোলা হয় প্রায় এক হাজার কোটি টাকার। অবৈধ অস্ত্র এবং চাঁদাবাজির কারণেই শান্তিচুক্তির অনেক সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। অস্ত্রধারীদের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ জানান, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ তৎপর রয়েছে। এখানে পুলিশ নিয়মিত মাদকদ্রব্য, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালায়। এ ছাড়া গ্রামে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। সেসব ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য পুলিশ নিয়মিত কাউন্সেলিং কার্যক্রমও চালায়। এ ছাড়া পাহাড়ে যেসব সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় আছে তাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনী সক্রিয় আছে। দুর্গম এলাকাতেও নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ আস্তানা ধ্বংস করছে, জঙ্গিদের গ্রেফতার করছে। অভিযোগ পেলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।

চুক্তির পর প্রধানমন্ত্রীর হাতে অস্ত্র সমর্পণ করেন সন্তু লারমা। ছবি : সংগৃহীত

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, শান্তিচুক্তির ২৫ বছরে পাহাড়ে ব্যাপক উন্নয়নকাজ হয়েছে। এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরকার শান্তিচুক্তি অনুযায়ী যথাযথ ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে, এ অঞ্চলে ভূমি জরিপ না হওয়া। এমনকি কাপ্তাই লেকেরও সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে এখানে ভূমিসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান দুরূহ হয়ে পড়ছে। 

স্থানীয় সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তির পরই তখনকার বিরোধী দল বিএনপি এর বিরোধিতা শুরু করে। এ চুক্তি সংবিধানবিরোধী উল্লেখ করে বাতিল করার ঘোষণা দেয়। চুক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার শুরু করে। আবার জনসংহতি সমিতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তারা পরবর্তী সময়ে চুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফের সঙ্গে হাত মেলায়। ২০০১ সালে তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতা সত্ত্বেও শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হয়েছে। তবে সরকার শান্তিচুক্তি অনুযায়ীই প্রতিটি পদক্ষেপ নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পাহাড়ে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা যারা বলছে তারা মূলত চাঁদাবাজ। তারা কখনোই এ অঞ্চলের মানুষের কল্যাণ চায় না। পাহাড়ি জনগণের কল্যাণে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের শান্তিচুক্তিই ছিল সবচেয়ে উপযোগী পদক্ষেপ। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাহাড়ে কার্যকরভাবে শান্তি ফেরাতে হলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাস নির্মূলের কোনো বিকল্প নেই। আর এটা তখনই সম্ভব যখন পাহাড়ি-বাঙালি উভয়ে উভয়কে আস্থার মধ্যে নেবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা