আকরাম হোসেন
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:০৭ এএম
ফাইল ফটো
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেড় দশকের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। তবে এখনও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বহুল কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা। নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে সময় ঘোষণা না করা, সংস্কারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব, ফ্যাসিস্টদের বিচার শুরুর বিলম্ব, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও সরকারের সমর্থনে নতুন দল গঠনের আভাসে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও গতিশীল, তাদের ভুল শুধরানো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলার উন্নতিসহ দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে চায় দলটি। এ মিশনে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্রদেরও পাশে চাইছে বিএনপি।
বিএনপি সূত্রমতে, চলতি মাসেই কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। গত ২৭ জানুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা করতে মিত্রদের সঙ্গেও বৈঠক করছে দলটির লিয়াজোঁ কমিটি। গত শুক্রবার ১২ দলীয় জোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেছে দলটি। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন শনিবার জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও এলডিপির সঙ্গে বৈঠক করে। ধারাবাহিকভাবে বাকি মিত্রদের সঙ্গেও বৈঠক হবে বলে জানা গেছে।
বৈঠকের বিষয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র রাশেদ প্রধান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের যে চাওয়া-পাওয়া ছিল, সেই জায়গায় অনেক ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে এবং দুর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে। গণহত্যার বিচার যেভাবে আমরা চেয়েছি, সেভাবে হচ্ছে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অন্যান্য কার্যক্রমও কচ্ছপগতিতে এগোচ্ছে। সামনে রমজান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আমরা কেউ আর নিতে পারছি না। দেশের বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে করণীয় নিয়ে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। আমরা আমাদের মতামত জানিয়েছি।
কর্মসূচি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিএনপির কোন ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করতে চাচ্ছে, সেসব বিষয়ে যদি আমাদের জানায় তাহলে ১২ দলীয় জোটের বৈঠকে আলোচনা-পর্যালোচনা করে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব। অতীতে বিএনপি যখনই কর্মসূচি দিয়েছে, আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে দিয়েছে। আশা করি, ভবিষ্যতে এমন কিছু হলে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে একত্রিতভাবেই দেবে। বৈঠকে কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা হয়নি। শুধু মতামত দিয়েছি আমরা। ভবিষ্যতে কর্মসূচি ঘোষণা করলে একসঙ্গেই করব।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও তাদের মিত্রদলগুলো। এ আন্দোলনে বিএনপির পাশাপাশি ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণতান্ত্রিক বাম জোট, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, গণফোরামসহ ৩৫টির বেশি দল অংশ নেয়। জামায়াত, এবি পার্টিসহ কয়েকটি দল আলাদাভাবে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে মিল রেখে একই কর্মসূচি পালন করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়তের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনের হিসাব-নিকাশে দুই মেরুতে অবস্থান করছে দল দুটি। এদিকে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগায়োগ রাখছে বিএনপি। দ্রুত নির্বাচনের দাবিও করে আসছে তারা।
বিএনপি সূত্র জানায়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রথম কাজ শেষ হয়েছে। শেখ হাসিনার পতন ঘটলেও এখনও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সামনের দিনগুলো ধোঁয়াশায় ঢাকা। কী ঘটতে যাচ্ছে কিছুই এখনও বলা যাচ্ছে না। সরকারের মধ্যে অনেক ভুল পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। তারা কী করতে চায়, কতটুকু সংস্কার করবে তা জানাচ্ছে না। মুখে শুধু সংস্কারের কথা বলছে। সংস্কারের কোনো সীমানা নির্ধারণ করেনি। এভাবে চলতে থাকলে বছরের পর বছর চলে যাবে। ফ্যাসিবাদের বিচার নিয়ে সরকারের অগ্রগতি কম, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার এখনও উন্নতি হয়নি। নির্বাচনের কোনো রোডম্যাপও ঘোষণা করেনি। এসব নিয়ে সরকারকে চাপে রাখতে চায় বিএনপি। এর অংশ হিসেবে চলতি ফেব্রুয়ারিতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ যাত্রায় যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে আগের মতোই পাশে চায় বিএনপি। লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে এসব জানতে চাওয়া হচ্ছে।
বৈঠকের বিষয়ে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সামনে রমজান আসছে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি। চালের দাম লাগামহীন। আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি হয়েছে। ফ্যাসিবাদের দোসরদের নিয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন হয়েছে। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। নির্দিষ্ট করে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে না। নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার আগে, এসব কথা বলছে। বিচারের প্রক্রিয়াও স্থবির হয়ে গেছে, গ্রেপ্তার হচ্ছে না। হঠাৎ আওয়ামী লীগের হুঙ্কার ইত্যাদি সমসাময়িক বিষয় নি3
য়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়েছে। ১২ দলের পক্ষ থেকে কিছু মতামত দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা করে মতামত নেবে বিএনপি। পরে তারা হয়তো একটা কর্মসূচি দেবে। ১২ দল যেহেতু যুগপৎ কর্মসূচিতে ছিল, এটা চলমান থাকবে। বিএনপির যেকোনো কর্মসূচিকে আমরা সমর্থন দিয়েছি, এখনও দেব।
বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন দল গঠনের প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া বক্তব্যে আপত্তি জানায় রাজনৈতিক দলগুলো। গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্ররা নিজেরাই একটি দল গঠন করবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাদের বললাম, পুরো জাতি তাদেরকে চেনে। তারা যা করতে চায়, সে বিষয়ে তাদেরকে একটা সুযোগ দিই। সুতরাং, তারা এটা করবে। সরকারপ্রধানের এমন মন্তব্য সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে কেউ কেউ মনে করেন প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে বোঝা যায় ছাত্রদের দল গঠনে তার মৌন সমর্থন রয়েছে, যা কিছুটা হলেও সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, যেকোনো দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি মানুষের কল্যাণে যেসব কাজ করা উচিত, সেসবে তাদের দ্বিমতের কোনো কারণও নেই। আমরা যুগপৎ আন্দোলন করেছিলাম। সেই আন্দোলন সবসময় সরকারের বিরোধী হবেÑ এমন কথাও নেই। যেকোনো আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আমরা যুগপৎ আন্দোলন একসঙ্গে করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ফ্যাসিবাদের পতন চেয়েছিÑ পতন হয়েছে, কিন্তু এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। দেশের জনগণের অবাধ সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ভোটের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে। এ রকম একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা কিছু সংস্কার প্রয়োজন; সেগুলো করেই নির্বাচন হবে। তার জন্য মিনিমাম যে টাইম সেটা তো লাগবে। কিন্তু মনে করি না সে সংস্কার করে নির্বাচন করতে বেশি সময় লাগার কথা।