× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ধর্ম ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নিঃস্ব কৃষক, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কি শীতঘুমে!

ফারুক আহমাদ আরিফ

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:০২ পিএম

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

শীতকালীন সবজির দাম পড়ে যাওয়ায় এবার বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। উৎপাদন খরচ না ওঠায় ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই নষ্ট করে ফেলতে হচ্ছে অনেককে। কৃষকরা যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় সেটি নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের। তারাই ফসলের উৎপাদন ব্যয়, কৃষক পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য এবং পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের বিক্রয়মূল্য কেমন হতে পারে তা বিশ্লেষণ করে যৌক্তিক মূল্য নিরূপণ করে থাকে। তবে এ বছর শীতকালীন ফসলের কোনো যৌক্তিক মূল্য বা উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়নি। কৃষকদের এবার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য এ বিষয়টিকেও কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে ফসল

প্রতিবছর আলুসহ অন্যান্য সবজি চাষ করে থাকেন ঠাকুরগাঁওয়ের সালন্দর ইউনিয়নের কৃষক ভিম পাল। তিনি জানান, গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবারও ৩ একর জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৯ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে। দাম পড়ে যাওয়ায় এবার তার লোকসান হবে ১ লাখ টাকার মতো। একই এলাকার কৃষক ফজলুর রহমান জানান, বর্তমানে ফুলকপির দাম নেই বললেই চলে। বাজারে নিলে প্রতি পিস ১/২ টাকায় বিক্রি করা যায়। তাই ফসল না তুলে ক্ষেতেই নষ্ট করে ফেলছেন। 

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় প্রতিবছর শীতকালে পর্যাপ্ত শাকসবজি উৎপাদন হয়। এবারও লাউ, শিম, করলা, টমেটো, বেগুন, শসা, মরিচসহ শীতকালীন সবজি আবাদ করছেন এলাকার কৃষকরা। ফলনও হয়েছে ভালো। তবে উপযুক্ত দাম না পেয়ে ক্ষেতের সবজি ক্ষেতেই নষ্ট করে ফেলছেন কৃষকরা। মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের কৃষক ইসমাইল হোসেন দুদু সওদাগর জানান, বাজারে লাউ ৪-৫ টাকায় বিক্রি করতে হয়, অথচ পরিবহনসহ প্রতিটি লাউয়ের পেছনে তার উৎপাদন ব্যয় ১০ টাকা। তাই বিক্রির দাম দিয়ে গাড়িভাড়াও ওঠে না। ফুলকপি ও বাঁধাকপির তো দামই নেই। বাধ্য হয়ে কপির ক্ষেত ট্রাক্টর দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছি। 

দুদু সওদাগর জানান, এ মৌসুমে তিন একর জমিতে তিনি শিম, ১০ কড়া জমিতে (স্থানীয় মাপ) ফুলকপি, ৪০ কড়ায় বাঁধাকপি, এক একরে লাউ চাষ করেছেন। গত বছর লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো বিক্রি করেছিলেন ১০ লাখ টাকার ওপরে। এ বছর এখন পর্যন্ত বিক্রি মাত্র ৫ লাখ টাকা। এবার শিম ক্ষেতে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত বিক্রি করেছেন মাত্র ২০ হাজার টাকার শিম। 

বাজারে সার পাওয়া যাচ্ছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতি বস্তা ইউরিয়া সার কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৪২০ টাকায়, মাটিয়া সারের দাম বস্তায় ৩০০ টাকা বেড়েছে। 

তবে সুবর্ণচরের শাকসবজির দাম নিয়ে ভিন্ন কথা বলেছেন নোয়াখালী জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মুমু পোদ্দার। তিনি বলেন, আমি গত বুধবার সুবর্ণচরে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলাম। সেখানে তিনি দেখে এসেছেন, কৃষকরা ১৫ টাকা করে ফুলকপি ও বাঁধাকপি এবং ১৮ টাকা করে লাউ বিক্রি করছেন। এসব ফুলকপি খুচরা পর্যায়ে ১৮-২০ টাকা এবং লাউ ২০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। তবে কোথাও যদি কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পায় সে ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে মার্কেট লিঙ্কেজ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। 

কী কাজ করছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর

এ যাবৎ বেশ কয়েকটি মৌসুমে কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তাতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পেলেও মোটামুটি কাছাকাছি একটা দাম পেয়েছে। কিন্তু এবার শীত মৌসুমের ফসলের দাম কেন নির্ধারণ করা হলো না তা জানতে চাইলে অধিদপ্তরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা (গবেষণা-২) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, একটি ফসলের উৎপাদন ব্যয় স্থানভেদে পার্থক্য হয়ে থাকে। ইতঃপূর্বে যখন বাজারে সবজিসহ কৃষিপণ্যের অস্বাভাবিক দাম ছিল তখন আমরা দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম। এখন যেহেতু পণ্যের দাম স্বাভাবিক আছে তাই দাম নির্ধারণ করা হয়নি। আশা করি, রমজানের আগে একটি মূল্য তালিকা দেওয়া হবে। কারণ রমজানে বাজারে কিছুটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। 

উৎপাদনের পূর্বে আগাম হিসাব ও উৎপাদনের সময়সহ মোট দুটি ব্যয়ের হিসাব দেওয়া সম্ভব কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে প্রায় ২০ বছরের বাজারদরের তথ্য রয়েছে। সেখান থেকে কাছাকাছি বছরে প্রায় একই সমান দাম ছিলে সেটিকে বেজলাইন ধরে আগাম দাম নির্ধারণের একটি অ্যাপস তৈরির কাজে হাত দিয়েছি। এটা করতে পারলে কৃষকরা এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তবে এ কাজের ক্ষেত্রে কৃষক, কৃষি অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম ও অন্যান্য অংশীজনের সহযোগিতা দরকার। 

সরকারের এ অবস্থায় কৃষকদের কী সুবিধা দিতে পারে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, উৎপাদনের পাশাপাশি বিপণন পর্যায়েও সরকার ভর্তুকি দিতে পারে, পরিবহনে সহায়তা দিতে পারে, এমনকি কৃষকের কাছ থেকে ভর্তুকি দামে কিনে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিক্রিও করতে পারে। কৃষি বিপণন আইন ২০১৮-এর ধারা ৪-এর ট তে মূল্য সহায়তা দেওয়ার ম্যান্ডেট অধিদপ্তরের রয়েছে। অর্থাৎ সরকারের এ বিষয়ে চিন্তা আগেও ছিল। এখন এটির বাস্তবায়ন দরকার। 

আমাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ২০-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায় উল্লেখ করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের গবেষণা অধিশাখার উপপরিচালক মোহাম্মদ রেজা আহমেদ খান বলেন, আমরা ভালো পরিমাণ উৎপাদন করি কিন্তু বিশাল একটা অংশ নষ্ট করে ফেলি। তার মধ্যে ফসল আহরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতের সময় ২০-৩০ শতাংশ নষ্ট করে ফেলি। এর ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এবার আমরা একটি কাজ করেছিÑ তা হলো যেসব অঞ্চলে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন হয়েছে, যেখানকার কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না, সেই পণ্যগুলো যেখানে কম উৎপাদন হয়েছে সে অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে বাজারজাতের ব্যবস্থা করেছি। এটি আরও বিস্তৃত আকারে করা দরকার। 

৪ পণ্যের যৌক্তিক দাম পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ করিম বলেন, উৎপাদন ব্যয় বের করতে হলে আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য নিতে হয়। সম্ভাব্য উৎপাদন ব্যয় বের করার সুযোগ আমাদের নেই। ফসল উৎপাদন হলে কৃষকের প্রকৃত ব্যয় কত হয়েছে মাঠ পর্যায়ে এসব হিসাব কষে আমরা যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে থাকি। এ মৌসুমে আমরা ৪টি পণ্যের উৎপাদন খরচ বের করে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণে কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সেখানে দেখা গেছে, প্রতিটি ফুলকপি উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে ১০ টাকা ২ পয়সা, বাঁধাকপিতে ৯ টাকা ৭৪ পয়সা। এক কেজি টমেটোতে ৯ টাকা ৮৭ পয়সা এবং এক কেজি বরবটিতে ১৯ টাকা ৫৪ পয়সা। 

বাজারে প্রতিযোগিতামূলকভাবে সাধারণ মানুষের পণ্য ও সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে প্রতিযোগিতা কমিশন কাজ করছে। কৃষকদের এবার লোকসানে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য ড. মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, পণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে আমরা কাজ করি। বাজারের পণ্যগুলোর দামের ওপর আমরা নজর রাখছি। বিশেষ করে, চালের দাম কেন বেড়ে গেল তা নিয়ে একটা মিটিং ডাকা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিযোগিতা আইনের ১৫ নং ধারা অনুযায়ী, পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও বাজারজাত বিষয় ও ১৬ নং ধারা মতে, ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। 

কৃষি অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোÑ বিবিএসের তথ্যমতে, দেশে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৬৫ লাখ। এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি। এই অসংগঠিত কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যদাম কীভাবে পাবে তার কোনো দিক-নির্দেশনা নেই।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত বছর বেশকিছু কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাত পর্যায়ে ব্যয় নিয়ে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেছিল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ এ কাজ করার জন্য বলে আসছি। 

তিনি আরও বলেন, স্থানভেদে উৎপাদনের খরচ বিভিন্ন ধরনের হয়। রংপুর ও কুমিল্লায় একই ধরনের ফসলের উৎপাদন ব্যয় এক হবে না। স্থানভেদে শ্রমিকের খরচ কমবেশি হয়। এ ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে, বিভিন্ন জোন ও ফসলভিত্তিক প্রত্যেক কৃষকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তারপর জাতীয় পর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় কত হবে তা বের করতে হবে। সেখানে কৃষকের বিক্রি কত ও বাজারে কত করে বিক্রি হচ্ছে তা বের করলেই মাঝখানে সরবরাহ ব্যয় কত হচ্ছে তা বেরিয়ে আসবে। আমাদের দেশে উৎপাদন ব্যয় প্রতিনিয়ত বের করা হয় না। আবার যা বের করা হচ্ছে তা বিচ্ছিন্নভাবে। এভাবে প্রতিনিয়ত হিসাব বের করা হলে নীতি-নির্ধারণে সহজ হবে। 

বিশ্বের অন্যান্য দেশে কীভাবে উৎপাদন ব্যয় বের করা হয় তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভিন্ন রকমের কাজ হয়। কেননা এসব দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ কৃষিতে জড়িত থাকে। বিশেষ করে ভারতে প্রতিটি রাজ্য বা উৎপাদনের এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তারা সব সময় বের করে থাকে। আর উন্নত দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ কৃষিতে জড়িত থাকে না। তারা যান্ত্রিক মাধ্যম বেশি ব্যবহার করে। উৎপাদনের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণও করে তারা। সেসব তথ্য তারা ওয়েবসাইটে দিয়ে থাকে। আমাদেরও এ ধরনের কাজে হাত দেওয়া দরকার।

কৃষক সংগঠনগুলোর শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, ভারতে প্রায় প্রতিবছর কৃষিপণ্যের দাম নিয়ে কৃষকদের আন্দোলন করতে দেখা যায়। তাদের দেশে শক্তিশালী কৃষক সংগঠন রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। এখানে কৃষকরা যেমন নিজেদের হয়ে কথা বলতে পারে না, তেমনি কোনো উল্লেখযোগ্য সংগঠনও নেই, যারা কৃষকদের ফসলের দাম নিয়ে কথা বলে। এটা চাইতে হলে অবশ্যই কৃষকদের একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা