× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

দায়ী বিচারহীনতার সংস্কৃতি

প্রবা প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:২১ এএম

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বরাবরই থেকেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিশেষ করে পুলিশ দলীয় বাহিনীতে পরিণত হওয়ায় দেশে ওই সময় পেশাদার অপরাধীদের দৌরাত্ম্য ছিল অনেক বেশি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। ঘটেছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

দেশের অপরাধ ও সমাজ-বিশ্লেষকদের বক্তব্যে এমন অভিমত উঠে এসেছে। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের ১৫ বছর আট মাসের শাসনকালে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। নৃশংস হত্যার ঘটনায় অনেক মামলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল পুলিশের ওপর। এর ফলে পুলিশ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদারত্ব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও থেকেছেন জবাবদিহিতার বাইরে। তারা দল ও ব্যক্তিস্বার্থে বিরোধী দল-মত, দমন-পীড়নে বেশি সময় পার করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নানা কৌশলে হত্যার মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়তেও দেখা গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, পুলিশকে নিজের পেশার বাইরে গিয়ে সরকারের গুণকীর্তন করা, কোনো ঘটনা তদন্তের নামে মিডিয়ায় মনগড়া গালগল্প প্রচার এবং নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসানোর জাল বিস্তারে মনোযোগী থাকতে দেখা গেছে। বাস্তবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের সক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়নি। এমনকি অপরাধ কেন বাড়ছে তা নিয়ে কোনো আলোচনা-গবেষণাও ছিল না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসকের) পরিসংখানে বলা হয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় এক হাজারের বেশি নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। তবে ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় হত্যার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ওই সময়কালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কি না সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। 

আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দুই মেয়াদে দশ বছরে দেশে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে কমপক্ষে এক হাজার ৭৯৮ জন। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে একই ধরনের বক্তব্য মিলেছে। 

বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে পুলিশের সঙ্গে। র‌্যাবের অভিযানে যেসব বন্দুকযুদ্ধ ও প্রাণহানি ঘটেছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে ডিবি ও থানা পুলিশের সঙ্গে। অন্যান্য ঘটনায়ও হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, একটি দেশে প্রতিবছর গড়ে তিন হাজারের বেশি খুন হওয়া আইনশৃঙ্খলার স্বাভাবিক পরিস্থিতির পরিপন্থি বলা যায়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বছরে গড়ে ৩ হাজারের বেশি খুন হওয়া মানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। গুম, অপহরণ, ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধও ছিল ভয়াবহ। কোনো সরকারের সময় যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন চিত্র আমরা দেখতে পাই তখন দেখা যায় পরবর্তী নির্বাচনে সরকারে থাকা ওই দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।

তিনি আরও বলেন, যখন দেশে খুন, ডাকাতি, চুরিসহ অন্যান্য অপরাধ বেড়ে যায় তখন দেখা যায়, অপরাধীরা কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে এসব অপরাধ করছে। অনেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমরা দেখেছি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সময় অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনায় দলটির নেতাকর্মীরা জড়িত ছিল। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আবার কোনো কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হলেও আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। যখন কোনো অপরাধী অপরাধ করে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছাড় পেয়ে যায় তখন অপরাধের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশে ৬০ হাজার হত্যাকাণ্ড স্বাভাবিক কোনো পরিসংখ্যান নয় বলে আমি মনে করি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবিএম নাজমুস সাকিব প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণে আমাদের দেশে অপরাধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। অপরাধীরা মনে করে যে সে যতই অপরাধ করুক তার কোনো সাজা হবে না। বিশেষ করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।’ 

তিনি বলেন, ‘অনেক হত্যা মামলায় আমরা বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দেখেছি, আবার কোনো কোনো হত্যা মামলায় দ্রুত বিচার হয়েছে গুরুত্ব এবং প্রোফাইল বিবেচনায়। এ জায়গা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, হত্যার মতো গুরুতর ঘটনার মামলাগুলো বিচারে পৃথক আদালত গঠন করা সময়ের দাবি। তাতে করে প্রতিটি হত্যার ঘটনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করা যাবে।’

দেশে অপরাধ বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের গবেষণা না থাকাকেও অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘কীভাবে আমাদের দেশে হত্যার মতো নৃশংস অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যায় বা বন্ধ করা যায় তা নিয়ে গবেষণা অনস্বীকার্য। এ ধরনের (হত্যা) অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্টদের কার কী ভূমিকা হবে তার কার্যকরী পর্যালোচনা জরুরি।’

নাজমুস সাকিব বলেন, ‘গত ১৫ বছরে শুধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে যে পরিসংখ্যানের কথা আমরা জেনেছি সেটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে নানাবিধ কারণে এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক বিরোধ, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই এমনকি ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাতে গিয়েও হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। এমনকি সম্পত্তিগত বিরোধেও প্রাণ যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশে যেকোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত শেষ হয় এবং প্রমাণসহ বিচারে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এ চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও প্রশিক্ষিত ও দক্ষ হতে হবে। সেই সঙ্গে জনগণকেও আলামত সংরক্ষণে সহযোগিতা করতে হবে। যেকোনো খুনের মামলার তদন্ত এমনভাবে করতে হবে, যাতে খুনির শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। বিচারব্যবস্থায় সাজা কঠোর এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর হলে কেউ আর এ ধরনের অপরাধে নিজেকে জড়ানোর সাহস পাবে না।’

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান ও পর্যালোচনার তথ্য বলছে- সীমান্ত হত্যা, নারী ও শিশুকে ধর্ষণ শেষে হত্যা, পারিবারিক সহিংসতায় হত্যা, পুলিশ হেফাজতে হত্যাসহ অনেক হত্যার ঘটনায় বিচার হয়নি। আবার বিপুলসংখ্যক ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। আবার যেগুলোর বিষয়ে মামলা হয়েছে সেগুলোও হয় তদন্ত কার্যক্রম ঝুলে গেছে অথবা দায়সারা প্রতিবেদন দেওয়ায় আদালতে বিচার ঝুলে গেছে। 

এই সময়কালে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ছিল ভয়াবহ। মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশে হত্যার মতো নৃশংস অপরাধ বেড়ে যায়। মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে শুরু করেছে যখন দেখেছে অপরাধ করলে কোনো শাস্তি হয় না। 

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান সব সময় পর্যালোচনা করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে তাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হয়। সে সঙ্গে অপরাধের ধরন, মানুষের আচার-আচরণ অনুযায়ী নিরাপত্তাব্যবস্থা বা পুলিশিং কার্যক্রম হওয়া প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘একটি হত্যাও কাম্য নয়। আর এত হত্যাকাণ্ড অবশ্যই উদ্বেগজনক। তবে এটিও চিন্তা করতে হবে, পৃথিবীর সব দেশেই অপরাধ হয়, হত্যার ঘটনা ঘটে। আর আমাদের দেশে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে। জনসংখ্যা অনুযায়ী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কত, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে।’ 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা