আরমান হেকিম
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১২:২১ পিএম
গ্রাফিক্স : প্রবা
রাজস্ব আদায়ে সরকারের অন্যতম প্রধান উৎস মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট। গত কয়েক বছর ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ক্রমাগত ভ্যাট বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য যখন গরিবের পকেট থেকে টাকা তোলা হচ্ছে, তখন ধনী এবং বড় ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে তাদের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে, ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য আরও গভীর হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে এমনিতেই কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। সেখানে নতুন করে শতাধিক পণ্যের ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে চাপ আরও বেড়েছে। অন্যদিকে এই চাপ থেকে স্বস্তি দিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে আট হাজার কোটি টাকা। আর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে রাজস্ব বাড়বে ১২ হাজার কোটি টাকা।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, ধনীদের প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে সরকার ভ্যাট বাড়িয়ে গরিবের ওপর আরও বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে। গরিবের ওপর বোঝা বাড়লেও তারা প্রতিবাদ করে না বা ততটা জোরালো হয় না কিন্তু ধনীরা নানা কৌশলে চাপ প্রয়োগ করে সরকারকে কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনে। এজন্য সব সময় সহজ লক্ষ্য হয় দরিদ্ররাÑ আর এর হাতিয়ার হয় ভ্যাট।
সম্প্রতি শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূসক বা ভ্যাটের হার ৫% থেকে ১৫% বাড়িয়ে আধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এতে রেস্তোরাঁর খাবার, হোটেল সেবা, পোশাকের আউটলেট, মিষ্টান্ন, নন-এসি হোটেল সেবা, বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার, ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। তবে গত বুধবার সমালোচনার মুখে ৯ পণ্যের ভ্যাট-শুল্ক কমিয়েছে সরকার। এ তালিকায় রয়েছে মোবাইল ফোন সেবা, রেস্তোরাঁ, নিজস্ব ব্র্যান্ডের পোশাক, মিষ্টি, নন–এসি হোটেল, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি।
তবে এনবিআর জানিয়েছে, এই ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে না এবং মূল্যস্ফীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, ভ্যাট বৃদ্ধির আওতায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অন্তর্ভুক্ত নয়।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ভ্যাট বৃদ্ধিতে নিত্যপণ্যের দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। এই কর বৃদ্ধিতে জনসাধারণের জন্য সমস্যা হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। তবে অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা তার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এনবিআর ভ্যাট আদায়ের কঠিন পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটছে। পরোক্ষ কর, অর্থাৎ ভ্যাট আরোপ করা তাদের এমনি একটি পদক্ষেপ। ভ্যাটের বকেয়া কিংবা রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটনের দিকে মনোযোগ দিলে ভ্যাট আদায় যদিও বাড়ত, তবে বিষয়টি কঠিন। তাই দ্রুত রাজস্ব আহরণ করতে এনবিআর নতুন করে ভ্যাটের হার বাড়িয়েছে। এতে দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে শুল্ক ও কর বাড়ানোর জন্য এই সময়টাকে যথোপযুক্ত মনে করছেন না এই অর্থনীতিবিদ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সরকারের ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হয়নি। ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর তালিকায় এমন অনেক পণ্য-সেবা আছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। শুধু গরিব মানুষই পড়বে না, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপরও চাপ পড়বে।’
তবে ভ্যাট বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, আইএমএফের চাপে নয়, ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়িয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতেই সরকার কিছু পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত কম থাকলে ঋণ পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং টাকার মান রক্ষা করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
৫০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পারছে না এনবিআর
মাঠে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা অনাদায়ি রেখে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করেছে এনবিআর। এর মধ্যে ৩১ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট-সংক্রান্ত মামলায় এবং পেট্রোবাংলার কাছে ২০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া।
বর্তমানে এনবিআরের আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকার ভ্যাট আটকে আছে। এর মধ্যে টোব্যাকো কোম্পানিতে আড়াই হাজার কোটি, মোবাইল অপারেটরে ১ হাজার ৭৫ কোটি, ফার্মাসিউটিক্যালসে ১৪০ কোটি এবং সিমেন্ট কোম্পানিতে ১০ কোটি টাকা।
এনবিআরের সদস্য ড. আব্দুর রউফ জানান, বকেয়া আদায়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কঠোর আইন প্রয়োগ সম্ভব না হওয়ায় আদায় প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। অর্থবছরের শেষে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বকেয়া আদায়ের আশা করা হচ্ছে।
মহার্ঘ ভাতায় খরচ ৮ হাজার কোটি টাকা
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য গ্রেডভিত্তিক মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। প্রস্তাব অনুযায়ী, ১ থেকে ৩ নম্বর গ্রেডে মহার্ঘ ভাতা হবে মূল বেতনের ১০ শতাংশ, ৪ থেকে ১০ নম্বর গ্রেডের চাকরিজীবীরা পাবেন ২০ শতাংশ আর ১১ থেকে ২০ নম্বর গ্রেডধারীরা ২৫ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা পাবেন। এতে সর্বনিম্ন ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত বেতন বাড়তে পারে। স্কেলের পার্থক্যের কারণেও কেউ ৪ হাজার টাকার কম মহার্ঘ ভাতা পাবেন না। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে বছরে ৭-৮ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হবে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বেতন-ভাতায় ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১০.৪১ শতাংশ। নতুন মহার্ঘ ভাতা কার্যকর হলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং রাজস্ব ঘাটতির এই পরিস্থিতিতে বাড়তি ব্যয় যুক্তিযুক্ত নয়। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ভাতা অর্থনৈতিকভাবে সংগত নয়। তবে নিম্ন গ্রেডের কর্মচারীদের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে সহজ পথ
সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণে শুল্ক-কর বাড়ানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে। শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যার ৫ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ে বরাদ্দ। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ইতোমধ্যে সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
বাজেটের ঘাটতি পূরণে ৫ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা শুল্ক-কর ও বিদেশি সহায়তা থেকে আসার কথা থাকলেও ২ লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে। তবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
রাজস্ব আদায়ে পিছিয়ে এনবিআর
সরকারের রাজস্ব ঘাটতি বর্তমানে ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা পূরণ করা জরুরি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ ২০ হাজার, যদিও অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। তবে গত অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৩৬ লাখ ৬২ হাজার। এর ফলে আয়কর আদায়ের লক্ষ্য পূরণে এনবিআর এখন চাপে রয়েছে। রিটার্ন দাখিলের সময় ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা প্রথমে ৩০ নভেম্বর ছিল।
সরকারি-বেসরকারি ৪৪টি সেবার জন্য রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হলেও তা লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করেনি। করদাতারা উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক সংকটের কারণে রিটার্ন দাখিলে আগ্রহ হারাচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং দেশের বর্তমান ব্যবসায়িক পরিস্থিতি রিটার্ন দাখিলে প্রভাব ফেলেছে, তবে তারা আশা করছেন যে শেষ সময়ে রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রবণতা বজায় থাকবে।
আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী, এনবিআরকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয়কর আদায় করতে হবে, যা বর্তমানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।