সাইফ বাবলু
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৪৫ এএম
ছবি : সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে বিস্ফোরণ ঘটানোর দুই দফা হুমকির নেপথ্যে কী রয়েছে তা খুঁজে দেখছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। এর পেছনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না সে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় দুইবার দুটি পৃথক দেশের কোড নম্বর থাকার কারণে বাড়তি সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তবে এ ধরনের ‘ভুয়া বার্তায়’ ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ালেও এ ঘটনায় থানায় কোনো সাধারণ ডায়েরি করা হয়নি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কিংবা আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের পক্ষ থেকে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, স্রেফ আতঙ্ক তৈরি করতেই কোনো বিশেষ মহল এ কাজ করেছে। আবার কারও মতে, বিমানবন্দরকেন্দ্রিক চোরাচালান চক্রের সুবিধার জন্যও এ ধরনের বার্তা দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে।
গত বুধবার ভোরে বিমান অবতরণের পর বিস্ফোরণ ঘটবেÑ এমন বার্তা পাঠানোর পর ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। একই দিন রাত ১১টায় বিমানবন্দরে বিস্ফোরক রয়েছে বলে দ্বিতীয় দফায় আরেকটি বার্তা পাওয়া যায়। এরপর বিমানবন্দরে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় দফায়ও কোনো কিছু মেলেনি। তবে ওই ঘটনার পর থেকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরসহ দেশের সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। যেসব নম্বর থেকে বিমানবন্দরে বিস্ফোরক থাকা এবং বিস্ফোরণ ঘটবে বলে বার্তা দেওয়া হয়েছে সেই দুটি নম্বরের আইপি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তারা বলছেন, কাজটি খুবই কঠিন। তবে চেষ্টা চলছে।
বিমানবন্দর থানার ওসি তাসলিমা আক্তার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, বিমানবন্দরে বিস্ফোরণ ঘটবে জানিয়ে মোবাইলে পাঠানো বার্তাটি ভুয়া ছিল। রাতের বার্তাটিও ছিল ভুয়া। এ ঘটনার পর পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ থানায় কোনো ধরনের অভিযোগ জানায়নি। পুলিশ যেহেতু বাইরের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে তাই এয়ারপোর্টের আশপাশে নজরদারি ও তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার ভোরের দিকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় থাকা আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ডিউটি অফিসার এএসপি আব্দুল হান্নানের সরকারি ফোনে একটি বার্তা আসে। পাকিস্তানের কোড ব্যবহার করা ওই বার্তায় ইতালির রোম থেকে ছেড়ে আসা বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে ৩৪ কেজি বিস্ফোরক থাকার তথ্য দেওয়া হয়। এরপর কয়েক দফায় ওই বিমানটি বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বিস্ফোরণ ঘটবে বলে জানানো হয়। ওই খবরে হুলস্থুল বেধে যায় বিমানবন্দরে। রোম থেকে আসা বিজি-৩৫৬ ফ্লাইটটি বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালে আড়াইশ যাত্রী নিয়ে জরুরি অবতরণ করে। বিমানটিতে তল্লাশি চালান আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা। বিমানযাত্রীদের লাগেজে তল্লাশি চালানো হয়। সবশেষ রাত ১১টার দিকে ফের আরেকটি বার্তা পাঠানো হয় আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের মোবাইল ফোনে। ওই বার্তায় বলা হয়, এয়ারপোর্টের ভিতরে বিস্ফোরক রয়েছে। দুটি লাগেজের ছবিও পাঠানো হয়। দ্বিতীয় বার্তাটির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় মালয়েশিয়ার কোড।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলছেন, যেকোনো থ্রেট পেলে আমরা তল্লাশি চালাতে বাধ্য। এটা প্রটোকলের মধ্যে রয়েছে। কে বা কারা হুমকি দিচ্ছেÑ তা খোঁজা হচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপে যে কেউই বাংলাদেশে বসেও পাকিস্তানের নম্বর ব্যবহার করতে পারেন। তবে এ ধরনের হুমকিদাতাদের কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার বিমানবন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল। ফ্লাইট উড্ডয়ন এবং অবতরণ সময়মতো হচ্ছে। তবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। একাধিক সংস্থার লোকজন দায়িত্ব পালন করছেন।
ভুয়া বার্তার নেপথ্যে কী থাকতে পারে
বিমানবন্দরে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিমানবন্দরে বিস্ফোরণ হওয়ার মতো তথ্য দিয়ে দুই দফা বার্তা পাঠানোর পেছনে মূল উদ্দেশ্য হতে পারে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। দুই দফা বার্তা পাঠানো হলেও এটি একই গ্রুপের কাজ। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ বার্তার পেছনে চোরাকারবারিদের হাত থাকার কথা নয়। কারণ চোরাচালান চক্রের সদস্যরা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে এমন বার্তা দেবে না। কারণ সে ক্ষেত্রে অতি দ্রুত বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এতে উল্টো চোরাচালান চক্রের সদস্যদেরই সমস্যায় পড়তে হয়। তারা অবৈধ মালামাল বের করতে অসুবিধায় পড়ে যায়। তাই মনে হচ্ছে, এটি এমন কোনো মহলের কাজ যারা এয়ারপোর্ট নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত বিমানবন্দরে একাধিক সংস্থা দায়িত্ব পালন করত। বিমান ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড পর্যন্ত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, কাস্টমস, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাহিনীসহ সকল সংস্থার সদস্যরা তল্লাশির জন্য যেতে পারতেন। বিমান পাহারা দেওয়ার কাজটি আগে এপিবিএন সদস্যরা করতেন। এখন ভেতরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এপিবিএন সদস্যরা শুধু বাইরে সন্দেহজনক লাগেজ তল্লাশি করতে পারে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ ভিওআইপি ও বিশেষ ধরনের অ্যাপস নামিয়ে এখন ডলার পেমেন্ট করে অনেকেই এখন বাংলাদেশে বসেই বিভিন্ন দেশের নম্বর ব্যবহার করতে পারেন। এসব নম্বর হুমকি, প্রতারণা, গুজব ছড়ানোসহ নানা কাজে ব্যবহার হচ্ছে। যে দুটি নম্বর থেকে বিমানবন্দরে বার্তা পাঠানো হয়েছে সেগুলোর আইপি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কারণ এসব নম্বর অবৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে ঢোকে। যারা ব্যবহার করেছে তারা প্রযুক্তিগতভাবে পারদর্শী। বুঝেশুনেই তারা এটি করেছে।
তবে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে কেউ পরিকল্পিতভাবে কাজটি করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বিমানবন্দরে বোমা হামলার থ্রেট দিলে তা বড় করে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হবে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে সবার নজরে আসবে। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো বন্ধ করার মতো পরিস্থিতিও হতে পারে। কোনো বিশেষ গোষ্ঠী হয়তো চাইছে, এমনটাই ঘটুক।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, দুটি বার্তা ছিল ভুয়া। কেউ ইচ্ছে করে এমন বার্তা ছড়িয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করতে পারে। আমরা তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। তবে এ ঘটনায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এবং দেশ-বিদেশের ফ্লাইট উড্ডয়নে বা অবতরণে কোনো প্রভাব পড়েনি।
রোমের ফ্লাইটে যেভাবে তল্লাশি
শাহজালাল বিমানবন্দরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বুধবার রোম থেকে আসা বিমানের ফ্লাইটটি সকাল ৯টা ২০ মিনিটে অবতরণের পর সেটিকে থার্ড টার্মিনালের সামনে একটু ফাঁকা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। যাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও মূল এয়ারপোর্টের কার্যক্রম চালানো যায়। অবতরণের আগ পর্যন্ত যাত্রীদের এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। তাদেরকে হাতব্যাগ রেখেই বোর্ডিং পাস নিয়ে নেমে যেতে বলা হয়। কয়েকটি বাসে তুলে যাত্রীদের আগে টার্মিনালে নেওয়া হয়। সেখানে বিমানের পক্ষ থেকে তাদের খাবার-পানিসহ আনুষঙ্গিক সেবা দেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, উড়োজাহাজের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, যাত্রীদের অনেকেই সিটের ওপর পাসপোর্ট, মোবাইল ফোন ফেলে গেছেন। তখন কয়েকশ বড় পলিব্যাগ আনা হয়। কেবিনের সিটের ওপর লকার থেকে যাত্রীদের প্রত্যেকটি ব্যাগ নামিয়ে তল্লাশি শেষে সিট নম্বর অনুযায়ী পলিথিনে প্যাক করে সেখানেই রেখে দেয়া হয়। ইউরোপ থেকে আসা যাত্রীরা হাতব্যাগে প্রচুর মালামাল ক্যারি করেন। এর মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা ছিল কোনো যাত্রীর মালামাল যেন খোয়া না যায়।
বিমানবন্দরের ওই কর্মকর্তা আরও জানান, পুরো উড়োজাহাজে তল্লাশি চালানো হয়। পুলিশের স্নিফার ডগ কাজে লাগানো হয। কার্গোর প্রত্যেকটি ব্যাগ বের করে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। প্রথমে সেগুলো বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করা হয়। পরে কুকুর দিয়ে শোঁকানো হয়। অনেক ব্যাগ খুলেও পরীক্ষা করা হয়। কিছু ব্যাগ এক্সরে করে দেখা হয়। পরে কিছু না পেয়ে দুপুর দেড়টার দিকে তল্লাশি শেষ করে ‘থ্রেট ক্লিয়ার’ঘোষণা করা হয়। এরপর বোর্ডিং কার্ড অনুযায়ী সিট নম্বর ধরে ২০-৩০ জন যাত্রীকে বাসে করে এনে আবার উড়োজাহাজে তুলে তাদের মালামাল সংগ্রহের জন্য বলা হয়। যাত্রীরা মালামাল বুঝে নিয়ে আবার বিমানবন্দরে ফিরে যান। তল্লাশি কার্যক্রমে অংশ নেন বিমানবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ সবগুলো সংস্থার সদস্যরা।