ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৩২ এএম
শীতজনিত অসুখ-বিসুখে ভুগছে শিশুরা। ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে মা নুসরাত জাহানের কোলে বসে খেলছে ১৪ মাস বয়সি আরোরা। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশুটি এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি। হাতে-পায়ে ক্যানোলা লাগানো। আরোরা বারবারই চেষ্টা করছে খুলে ফেলতে। জ্বর এখনও ভালো সারেনি, শরীরও দুর্বল।
মা নুসরাত জাহান বলেন, আমারও কিছু ভুল আছে। বাচ্চা টয়েলেট করলে বেশি পরিষ্কার রাখার জন্য বারবার ঠান্ডা পানি দিয়ে মুছতাম। এই শীতে আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল। প্রথমে জ্বর আর বমি, তারপর ভৈরবের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে এখানে পাঠানো হয়েছে আমাদের। এখন নিঃশ্বাসে তেমন একটা সমস্যা হচ্ছে না। হয়তো আরও তিন-চার দিন থাকতে হবে।
উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক চলছে আরেক শিশু সাফহা রোজার চিকিৎসায়। হঠাৎ শৈত্যপ্রবাহ ও ঠান্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি বলে জানান মা শারমিন আক্তার। জ্বর ছাড়া আর কোনো সমস্যা না থাকায় বুঝতে পারেননি রোজার নিউমোনিয়া হতে পারে। অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে ডাক্তারের কাছে আসেন। শারমিন বলেন, হঠাৎ করেই ঠান্ডা পড়ে যাওয়ায় আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি তার মেয়েটি। হাসপাতালে ভর্তির পর প্রথম দিকে অক্সিজেন দিয়ে রাখতে হয়েছিল। সকাল থেকে নিঃশ্বাস নিতে পারছে।
গতকাল সোমবার শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ঘুরে দেখা যায়, শীতজনিত অসুখে আক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগই কয়েক মাস থেকে তিন বছরের মধ্যে। অনেক শিশু আক্রান্ত হচ্ছে একাধিকবার।
১৫ দিন আগে সুস্থ হয়ে হাসাপাতালে ভর্তি ১৯ মাসের শিশু রাইসার মা সুমাইয়া বেগম বলেন, বাচ্চা নিজের সমস্যা প্রকাশ করতে পারে না। ১৫ দিন আগে নিউমোনিয়া হয়েছিল। এই হাসপাতাল থেকেই সুস্থ করে নিয়ে গেছি। এখন আবার নিউমোনিয়া হয়েছে। গরম কাপড়-চোপড় দিয়ে রাখলেও ধরে ফেলে দেয়। গোসল করালেই সমস্যা দেখা দেয়। বারবার নিউমোনিয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হচ্ছে। এতে বাচ্চার শরীরটাও দুর্বল হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের তথ্য মতে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ডিসেম্বরে ভর্তি হয়েছে ২১৬ জন, জানুয়ারির ছয় দিনে ১৯ জন। বর্তমানে হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন আছে ৩১ জন। এই রোগে চলতি মাসে মারা গেছে দুজন। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ১১৩ শিশু। ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৫১১ জন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ১০৩ জন।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এবার জানুয়ারিতে একটু কম রোগী আসছে আগের বছরের তুলনায়। প্রতিবছর শীতে ঠান্ডাজনিত রোগ বেড়ে যায়, এটা স্বাভাবিক। ডায়রিয়া নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে শিশুরা ভর্তি হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘটে বায়ুদূষণের কারণে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের তথ্য অনুসারে, গত ১৫ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৮৫ হাজার ৪৬৯ জন। মারা গেছে ১৯ জন।
আইসিডিডিআরবির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে শীর্ষ পাঁচটি সংক্রামক রোগের মধ্যে নিউমোনিয়া একটি। সংক্রামক রোগে শূন্য দশমিক ৭ মিলিয়ন মৃত্যুর ১৪ শতাংশ হয়ে থাকে নিউমোনিয়ায়। দেশে নিউমোনিয়ায় প্রতিবছর মারা যায় কমপক্ষে ২৪ হাজার শিশু।
ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্টেও ভুগছে শিশুরা
শীতকালীন ডায়রিয়া নিয়ে ডিসেম্বরে ৭৫ জন শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। জানুয়ারিতে এখন পর্যন্ত তিনজন ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছে ১৩৪ জন। নিউমোনিয়া ছাড়াও ঠান্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ শীতকালীন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের নিয়েও অভিভাবকরা ভিড় করছেন হাসপাতালে। ছোট থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা পাঁচ বছর বয়সি আদনানের। শীত এলেই শ্বাসকষ্ট বাড়ে। আদনানের বাবা মো. ইব্রাহিম বলেন, ঢাকায় ধুলোবালি মারাত্মক। এর মধ্যে ঠান্ডাও হঠাৎ করে এসেছে। বাচ্চাকে প্রথম স্কুলে পাঠাতে শুরু করেছি। আগে বাসায় থাকত। এখন তো বাইরে যেতেই হয়। এই অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ায় তাকে সুস্থ রাখাই কঠিন।
এদিকে ঢাকার বাতাসে গতকালও ছিল ভয়ানক দূষণ। বিশ্বের ১২৬টি শহরের মধ্যে সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ ছিল ঢাকায়। বাতাসে যে দূষণ রয়েছে, তা সংবেদনশীল মানুষের জন্য তো বটেই, সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য অনেক ক্ষতিকর। সকালে ঢাকার বায়ুমান পরিমাপ করা হয় ২৬৬। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে বিশুদ্ধ বাতাস ধরা হয়। ৫১-১০০ হলে তা সহনীয়। ১০১-১৫০-এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১-২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর। সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস দুর্যোগপূর্ণ।
শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক নাবিলা আকন্দ বলেন, নিউমোনিয়ার প্রধান কারণ বায়ুদূষণ। শিশুরা বেশিরভাগই বাতাসে আসা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া মাধ্যমে আক্রান্ত হয়। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এই ধরনের জটিলতায় ভোগা শিশুর সংখ্যা কমবে।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল আলম বলেন, শীতের সময় ধুলোবালি ওড়ে বেশি। শিশুদের এ সময় অনেক যত্ন নিতে হবে, বাবা-মাকে সতর্ক থাকতে হবে। বাইরে ধুলোবালিতে নেওয়া যাবে না। গেলেও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। উষ্ণ পানি ব্যবহার করতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট মূলত শীতে ধুলোবালি থেকে ছড়ায়। একটা হলো পানিবাহিত দূষণ, আরেকটি বায়ুবাহিত। শীতের ধুলোবালিতে খাবারগুলোতে জীবাণু গিয়ে পরে সেই খাবার থেকে ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবশ করে। এতে করে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া দেখা দেয়। প্রথমবার ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয় ব্যাকটেরিয়ার জন্য। প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। পরে ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো সহজেই আক্রান্ত করতে পারে।
এ বছর নিউমোনিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বছর নিয়ে শেষ কথা এখনও বলা যাবে না। ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে তার প্রধান কারণ আবহাওয়ার পরিবর্তন। বৃষ্টি দেরিতে হওয়া, শীতের প্রকোপের সঙ্গে ভাইরাসের আক্রমণও রয়েছে। এখন ডায়রিয়ার রোগী বেশি আসছে, সামনে নিউমোনিয়ার রোগী বাড়তে পারে।