ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১৭ এএম
গ্রাফিক্স : প্রবা
সচরাচর বর্ষা মৌসুমেই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যেত। এখন বর্ষা শেষ হলেও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কাটে না। এ বছরও ডেঙ্গুর মৌসুম দীর্ঘ হয়েছে। নভেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকবে এবং তা ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জনসচেতনতার অভাব, স্থানীয় সরকারের নজরদারিতে অবহেলাসহ জলবায়ু পরিবর্তনকেও এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা। যে কারণে ঢাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে কিছু কাজ হলেও তেমন একটা সুফল মিলছে না।
গত মাসে অর্থাৎ অক্টোবরের প্রথম ৯ দিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩৩। নভেম্বরের ৯ দিনেই মৃত্যু হয়েছে ৫৩ জনের। অক্টোবর মাসে মোট মৃত্যু হয়েছিল ১৩৪ জনের। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সেপ্টেম্বরে মৃত্যু হয় ৮০ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরও ১ হাজার ১৩৪ জন। মারা যাওয়া ৮ জনের মধ্যে ৩ জন পুরুষ, ৫ জন নারী। তাদের মধ্যে ৪ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের, একজন ঢাকা উত্তর সিটির, ২ জন বরিশাল বিভাগের ও একজন চট্টগ্রাম বিভাগের বাসিন্দা। এ বছর এখন পর্যন্ত এডিস মশাবাহিত এই রোগে মারা গেছেন ৩৫০ জন। মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৭১ হাজার ৫৬ জন।
ডেঙ্গুতে পুরুষের তুলনায় নারীর মৃত্যুহার বেশি। যেখানে আক্রান্তদের ৩৭ শতাংশ নারী ও ৬৩ শতাংশ পুরুষ, সেখানে মৃত্যুর দিক থেকে ৫১ শতাংশ নারী ও ৪৯ শতাংশ পুরুষ। এ বছর এখন পর্যন্ত ১ থেকে ১৫ বছর বয়সিদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৫৬ শিশুর, যা মোট মৃত্যুর ১৩ শতাংশ। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের বাসিন্দা ১৫৯ জন, উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬৪ জন। মোট মৃত্যুর ৬০ শতাংশই হয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে। বাকি ৪০ শতাংশ ঢাকা মহানগরের বাইরে। বরিশালে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৮, খুলনা বিভাগে ২১, ঢাকা বিভাগে ১৬, ময়মনসিংহে ৭, রংপুরে ২, রাজশাহী বিভাগে ১ জন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ১ জন মারা গেছে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, তিন কারণে ডেঙ্গু মশা এখনও তাণ্ডব চালাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়া ও এডিস মশার প্রজনন। বৃষ্টির সঙ্গে এখন প্রজননের সম্পর্ক নেই। কারণ বৃষ্টি না হলেও বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানি থেকে মশার বিস্তার ঘটছে। যেখানে গ্যারেজ আছে এবং গাড়ি ধোয়া হয়, সেখানেও মশার প্রজনন হচ্ছে। মানুষ বালতি, ড্রামে জমানো পানি রেখে দেয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশার ঘনত্ব কমিয়ে ফেলা বা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে। সময়মতো আরও কিছু কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, তাহলে ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধ করা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, চলতি মৌসুমে এডিস মশার ঘনত্ব বর্তমানে কমতে শুরু করেছে। বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি গত দুদিন ধরে রাজধানীতে মশার ঘনত্ব কমছে। তবে মশার ঘনত্ব কমলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে না। আরও ১৫ দিনের মতো সময় লাগে। সেদিক থেকে নভেম্বরের শেষের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমতে পারে বলে ধারণা করা যায়। তবে ডেঙ্গুর শঙ্কা ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকবে। নভেম্বরে মৃত্যুর হার অক্টোবরের তুলনায় বেশি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটির ২০টি অঞ্চলে ২০টি টিম তদারকি করার কথা থাকলেও তাদের ঠিকমতো মাঠে দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে ডেঙ্গু নিধনে তাদের উদ্যোগ তেমন কাজে আসছে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা মাহবুব রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর মশক নিধনে সেভাবে কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। ইদানীং আবার দেখা যাচ্ছে। তবে সেটা কম। আন্দোলনের সময়েও সেভাবে কাজ করেনি কর্তৃপক্ষ। তখন থেকে কাজটা চলমান থাকলে ডেঙ্গু এবার এতটা ভয়াবহ হতো না।
জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটির সাবেক দুই মেয়র দায়িত্বে থাকাকালে প্রতি অর্থবছরে ডেঙ্গু নিধনে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হলেও তার সদ্ব্যবহার হয়নি। বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা খরচ করেও মশা নিধনে তারা বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের জায়গায় প্রশাসকদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও অবস্থা আগের মতোই দেখা যাচ্ছে। দিনদিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলেও মাঠ পর্যায়ে মশা নিধনের তৎপরতা নেই বললেই চলে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এই অবস্থার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তন একটা বড় কারণ। দুদিন আগেও বৃষ্টি হয়েছে। এতে করে মশা ডিম পাড়তে শুরু করেছে আবার। এদিকে নভেম্বরে শীত নামার কথা থাকলেও এখনও শীত সেভাবে আসেনি। এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শীতটা এলে হয়তো ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে।
তিনি প্রশাসনের সমালোচনা করে বলেন, খুব সক্রিয়ভাবে কাজ হচ্ছে না। প্রত্যেকটা ওয়ার্ড যদি নিজ নিজ এলাকার দায়িত্বটা নিতো, তবে ভালো হতো। তাদের সঙ্গে যদি শিক্ষার্থীদের যুক্ত করত, তাহলেও কিছু কাজ হতো। এ ছাড়া যে ওষুধ দেওয়া হয় সেটা উড়ন্ত মশা মারার জন্য। ডিমগুলো ধ্বংস করতে হবে। মশার ওষুধের ক্ষেত্রেও সেটা কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা নেই। সেগুলোর মেয়াদ আছে কি না তাও তো জানতে হবে।
এদিকে দাযিত্ব পালনে অবহেলা বা ব্যর্থতার অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে সামছুল কবির বলেন, ঢাকায় মৃত্যুর যে তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিচ্ছে তা সঠিক নয়। এখানে ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীরাও ভর্তি হয়ে মারা যাচ্ছেন। ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণের বাসিন্দাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের। আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার। বাকিরা সবাই ঢাকার বাইরের রোগী।
তিনি আরও বলেন, আমরা নিয়মিত প্রতিটি ওয়ার্ডে মশক নিধন কার্যক্রম করছি। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর এলাকার ৪০০ গজ পর্যন্ত তদারকি করে যাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্ট কাজ করছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেও সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত ৮৩৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা কাজ করেছি।
একই বক্তব্য ঢাকা উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরীরও। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ থেকে নাগরিকদের রক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টি, মশার প্রজননস্থল বিনষ্টকরণ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা এবং লার্ভা ও মশা নিধন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মাইকিং, লিফলেট বিতরণ, র্যালি এবং বাড়ি-বাড়ি এডিস মশার প্রজননস্থল অনুসন্ধান করে ধ্বংস করার ফলে গত বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কম। আমরা এটি আরও নিয়ন্ত্রণে আনার কার্যক্রম জোরদার করেছি। উত্তর সিটির ৩৬টি নগর মাতৃসদন ও মাতৃকেন্দ্রে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগীর তালিকা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি এবং কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের ব্যবস্থা করছি। প্রায় ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাচ্ছি রোগীর ঠিকানা ডিএনসিসি দেখানো হলেও তিনি আসলে এই এলাকার বাসিন্দা নন। রোগীর তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকার চেয়ে ডিএনসিসি এলাকার প্রকৃত রোগীর সংখ্যা অনেক কম।
একটি কার্যকর ও সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।