দীপক দেব
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫৮ এএম
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ফটো
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গত তিন মাস ধরে দেশকে অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, সামষ্টিক অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেও সরকার কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তবে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকার সন্তোষজনক ভূমিকা পালন করতে পারছে না বলে মনে করছেন তারা। অবশ্য তারা এ-ও মনে করছেন, সরকারের সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করার জন্য তিন মাস যথেষ্ট সময় না।
বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, দ্রুততম সময়ে সরকার তার রাজনৈতিক অগ্রাধিকার তথা রোডম্যাপ পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে নিজেদের লক্ষ ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার করবে। নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার পাশাপাশি তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন নিয়ে সরকারের পরিষ্কার বক্তব্য থাকা উচিত। রাজনৈতিক দল ও জনগণকে আস্থায় নিয়ে কাজ করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে শুরু হওয়া জুলাই আন্দোলন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এর প্রায় ৭২ ঘণ্টার পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। আজ ৮ নভেম্বর বর্তমান সরকারের তিন মাস পূর্ণ হচ্ছে।
সারা দেশে তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনের অবসান ঘটলেও এর পরপরই সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। বিগত সরকারের সময় পুলিশ বাহিনী আগ্রাসী ও ও অপেশাদার আচরণের মধ্য দিয়ে নিজেদের জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর ফলে সারা দেশে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। এজন্য আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং সরকার পতনের প্রথম ৭২ ঘণ্টায় সারা দেশে পুলিশ বাহিনীর ওপর সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে সরকার গঠনের পরেও অনেক পুলিশ কাজে যোগ না দিয়ে আত্মগোপনে থাকে। বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, এসব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সরকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে শান্ত ও স্থিতিশীল করতে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে চলেছে। এ ছাড়া প্রত্যাশিত সংস্কার নিয়েও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ব্যাংক লুট ও পাচার হওয়া টাকা বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনারও প্রচেষ্টা চলছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক অগ্রগতি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
তিন মাসের কার্যক্রমে পুরোপুরি মূল্যায়ন সম্ভব নয় : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘কিছু কিছু অগ্রগতি ঘটলেও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অসম্পূর্ণতা বা ব্যর্থতা রয়েছে। কিন্তু এইটুক দিয়েই এই তিন মাসের মধ্যে সরকারের কার্যক্রম পুরোপুরি মূল্যায়ন করা যায় না। তবে এটুকু বলা যায়, এখনও একটা অনিশ্চয়তার ছায়া এবং অন্ধকার রয়ে গেছে। এখানে একটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি পঙ্ক্তি বলতে চাই, ‘জয় করে তবু ভয় কেন মোর যায় না’। মানুষের মধ্যে সামনের দিনগুলো নিয়ে নানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং নানারকম গুজবও দেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। সাধারণ মানুষের অনেক চাহিদার ভেতরে অগ্রাধিকারভিত্তিক চাহিদা ছিলÑ জীবন-জীবিকার সমস্যাগুলোর সমাধান হবে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আগের মতো থাকবে না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আসবে। সেই আশা সরকার এখনও পূরণ করতে পারেনি।’
প্রবীণ এই বামপন্থি নেতা বলেন, ‘এখনকার সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের বিজয় যেন হাতছাড়া না হয় সেজন্য সতর্ক পাহারা দিয়ে চলা। একটা কথা আছেÑ জমি বর্গা দেওয়া যায়, কিন্তু স্বার্থ বর্গা দেওয়া যায় না। এই অভ্যুত্থানের নায়ক জনগণ। সেই জনগণ যদি স্বার্থ বর্গা না দিয়ে সজাগ সতর্ক থাকে, তাহলে এই বিজয় কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না।’
অগ্রাধিকারের রোডম্যাপ থাকা চাই : সাইফুল হক
সরকারের তিন মাসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘এই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের দিক হচ্ছে, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট অস্থির অবস্থা থেকে দেশকে স্থিতিশীল অবস্থার দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে চলেছে। ভারতের মতো একটা প্রভাবশালী প্রতিবেশীর বৈরিতার মধ্যেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সরকারের দুর্বল দিকগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনে এখনও গাছাড়া ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে ইতিবাচক সফলতা রয়েছে। ধীরে ধীরে অর্থনীতির চাকা অগ্রসর হচ্ছে।’
রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে না পারা এই সরকারের আরেকটা দুর্বলতা বলে মনে করছেন সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘যৌক্তিক সময়ের মধ্যে দেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এ সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়টি সুস্পষ্ট করলে সাধারণ মানুষ তাদের ধন্যবাদ জানাবে।’ তবে সার্চ কমিটি গঠন ও সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠনের বিষয়টিকে ইতিবাচক মনে করছেন তিনি। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘সরকারের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা দোদুল্যমানতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, প্রথমে সংস্কার তারপর জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন। আবার কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের যাত্রা শুরু হয়েছে। এখানে আসলে সরকারের বক্তব্য কোনটা, সেটা পরিষ্কার নয়।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা বলেন, ‘যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো সম্পন্ন করা অনেক সময়ের বিষয়। এজন্য তারা বিষয়টি শুরু করে নির্বাচিত সরকারের ওপর সম্পন্ন করার জন্য ছেড়ে দিতে পারে।’ তিনি মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের সময়কালে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে কিছুটা চিড় ধরেছে এবং সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলো সব ধরনের সহযোগিতা করার পরও সরকারের তৎপরতায় জনগণ এক ধরনের দুর্বলতা লক্ষ করছে।’
কিছু কার্যক্রমে অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনারাবৃত্তি ঘটছে : ড. সাব্বির আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘এই সরকার দুটো জায়গায় সন্তোষজনক কিছু করতে পারছে নাÑ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। তা ছাড়া এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা সাধারণ মানুষেরা প্রত্যাশা করেছিলাম, অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু কিছু কার্যক্রমে অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিশেষ করে যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে চাকরি থেকে বরখাস্ত বা নিয়োগ দেওয়ার বিষয়গুলো অনেকের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।’
ড. সাব্বির আহমেদ অভিযোগ করেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ের নিয়োগগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অধিকাংশেরই বাড়ি চট্টগ্রাম না হয় কুমিল্লা। আবার ধরেন, পুলিশের এসআইদের অব্যাহতি দেওয়া, বিসিএস বাতিল করে দেওয়াÑ যে কাজগুলো একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছে, সেগুলো একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মূল্যায়ন করা যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। আগের মতোই এক ধরনের জিঘাংসার প্রকাশ ঘটেছে। আমরা বাংলাদেশে একটা সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা, সুস্থ ধারার শাসনতান্ত্রিক চর্চা প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু তা লক্ষ করা যাচ্ছে না। সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কমিশন করা হচ্ছে। আমার কাছে মনে হয়, সংস্কার আসলে হওয়া উচিত ছিল মনের সংস্কার। মনের সংস্কার না করলে এই দেশের মানুষের মুক্তি নাই।’
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার জন্য আইনকানুন পরিবর্তন করবেনÑ করাটাই স্বাভাবিক। তবে এই আইনকানুন করতে গিয়ে তারা নিজেরাই যদি ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠেন, তাহলে এটা সকলের জন্যই বিপদ হবে। তবে আমি আশা করছি, আমরা একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে স্থিতিশীলতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছি।’