× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সরেজমিন জেনেভা ক্যাম্প

উদ্বাস্তুদের নয়, যেন মাদকের ক্যাম্প

পারভেজ খান

প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ১১:২৫ এএম

গ্রাফিক্স প্রবা

গ্রাফিক্স প্রবা

ঢাকা যেমন দেশের রাজধানী, ঠিক তেমনি মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প যেন সারা দেশের মাদক বাণিজ্যের ‘রাজধানী’। অপরাধ জগতের নথিপত্রে এভাবেই পরিচিত উদ্বাস্তুদের বসবাসের জন্য ঢাকায় গড়ে তোলা এই ক্যাম্প। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয় সারা দেশের মাদক বাণিজ্য। সম্প্রতি মাদকের পাশাপাশি অস্ত্র বেচাকেনাও শুরু হয়েছে এখানে। ছিনতাই-রাহাজানি, চুরি-ডাকাতি, খুন এখানকার বাসিন্দাদের কাছে নিত্যদিনের ঘটনা। চিহ্নিত ২৫ সন্ত্রাসীর সমন্বয়ে একটি সিন্ডিকেট এখানে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশের ১৩টি জেলার রিফিউজি ক্যাম্পে রয়েছে তাদের আঞ্চলিক ঘাঁটি। এসব কেন্দ্র থেকে ভাড়াটে খুনি হিসেবেও তারা কাজ করে সারা দেশে। তবে মূল ব্যবসা তাদের মাদকের বেচাকেনা। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করেই তারা প্রকাশ্যে এই অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে তাদের যে মাদকসেবী ক্রেতা, তারা নেশার টাকা জোগাড় করতে বেছে নিচ্ছে ছিনতাই, ডাকাতির পথ। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে এমন চিত্র উঠে এসেছে ক্যাম্প এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে। 

জানা যায়, সারা দেশের ১৩ জেলার ৭০টি রিফিউজি ক্যাম্পেই এই মাদক সিন্ডিকেটের ঘাঁটি রয়েছে। জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নীলফামারী, খুলনা, যশোর, পাবনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ ও দিনাজপুর। ঢাকার মিরপুরে ২২টি, মোহাম্মদপুরে ৬টি, নীলফামারীর সৈয়দপুরে ২২টি, খুলনায় ৯টি এবং পাবনার ঈশ্বরদী ক্যাম্পের ঘাঁটিগুলোতে অপরাধ আর অপরাধীর সংখ্যা অন্য ক্যাম্পগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। 

স্থানীয় সূত্রমতে, জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর মাদক ব্যবসার নেপথ্যে সব সময়ই থাকেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মকবুল হোসেনের হাত ধরেই এই সিন্ডিকেটের উত্থান। পরে এদের আশ্রয়দাতা হিসেবে আসে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি সাদেক খান, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবীর নানক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের পলাতক কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নুর ইসলাম রাষ্টনসহ কয়েকজনের নাম। এদের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে কেউ এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। 

সরেজমিন যা দেখা গেল

গতকাল শনিবার ভোর সাড়ে ৪টা। মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের প্রবেশপথে এসে দাঁড়াল একটি রিকশা কাভার্ড ভ্যান। যেসব ভ্যানে সাধারণত বেকারির রুটি বিস্কুট কেকজাতীয় পণ্য সরবরাহ করা হয়। ভ্যানটি পৌঁছামাত্রই ঘিরে দাঁড়াল ৬-৭ যুবক। কথা শুনেই বোঝা যায় এরা বিহারি ও জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা। ভ্যান থেকে নামানো হলো মাঝারি সাইজের আটটি কার্টন। যুবকরা সেগুলো নিয়ে দ্রুত ক্যাম্পের গলি ধরে ভেতরে ঢুকে গেল। ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেল রিকশা ভ্যানটিও। 

ঘটনাস্থলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে থাকা স্থানীয় এক সোর্স জানালেন, ওই কার্টনগুলোয় আছে ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন আর গাজা। পাশেই (প্রায় ৫ গজ দূরে) একটি হাইস্কুলের সামনে বসে ছিলেন কয়েক পুলিশ সদস্য। তাদের চোখের সামনেই ঘটল পুরো ঘটনা।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ সদস্যদের একজন জানালেন, ‘ভাই, ওদের কাছে আমাদের চেয়েও উন্নতমানের অস্ত্র আছে। ফলে সব দেখেও চোখ বন্ধ করে থাকতে হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের ওপর মহলের নির্দেশ আছে, ভেতরে না ঢোকার। বিশেষ করে, এই অন্ধকারে তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু সেনাসদস্যরা যখন যৌথ অভিযান চালান, তখনই তাদের সাথে আমরা থাকি। এ ছাড়া আমাদেরও যদি কোনো বিশেষ অভিযান চলে তখন যাই। ভেতরের পরিস্থিতি খুবই ভয়ানক। ৫ আগস্টের ঘটনায় লুট হওয়া অনেক অস্ত্র এই সিন্ডিকেটের হাতে আছে।’

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে একটি লম্বা লাইন দেখে থমকে যেতে হয়। টিসিবির পণ্য বিক্রির সময় ক্রেতারা যেভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য সংগ্রহ করেন, ঠিক সে রকমই ২০-২২ জনের একটি লাইন। তিনজন মাদক বিক্রেতা তাদের কারও হাতে ফেনসিডিল, কারও হাতে হেরোইনের পুরিয়া, আবার কারও হাতে গাঁজার প্যাকেট তুলে দিচ্ছে। পাশের আরেকটি লাইনেও একই অবস্থা। প্রকাশ্যে চলছে মাদক বেচাকেনা। কোনো রাখঢাক নেই। মেলে ধরা হাতে ডালা সাজিয়ে মাদক বিক্রি চলছে। ক্যাম্পের এ-ব্লক শেষে বি-ব্লক আর সাত নম্বর সেক্টরে গিয়েও দেখা গেল একই পরিস্থিতি। স্থানীয় সোর্স জানালেন, ‘ভাই এটা তো সামান্যই দেখলেন। আসল খেলা চলে সন্ধ্যার পর। চলে সারা রাত। ডিজে লাইট জ্বালিয়ে রাতভর রমরমা মাদকের মেলা চলে এই ক্যাম্পে। তার সাথে চলে উচ্চৈঃস্বরে গানবাজনা।’ 

রাশেদ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা এই প্রতিবেদককে বলেন, আগে এই মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করত ইশতিয়াক আর পাচ্চিশ নামে দুই শীর্ষ মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী। পাচ্চিশ ক্রসফায়ারে এবং ইশতিয়াক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এরপর এই সিন্ডিকেট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এখন সিন্ডিকেট দুটি নিয়ন্ত্রণ করছে ২৫ শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি মিলে। এরা হচ্ছেÑ মোল্লা আসাদ ওরফে আরশাদ, মোল্লা বশির, বুনিয়া সোহেল (গত বুধবার গ্রেপ্তার), চুয়া সেলিম, কানা জিলানী, রাব্বানী, বাবু, বোম, পাকিস্তানী রাজু (ইশতিয়াকের ভাই), মনু ওরফে গালকাটা মনু, ইমতিয়াজ (বর্তমানে কারাগারে), তিল্লী সাহিদ, এরফান, মুখজালা আকরাম, কামরান, বিরানী কামাল, বিরানী বোবা, ফেলু আরমান, পাচু (৭ বছর জেল খেটে কিছুদিন আগে ছাড়া পেয়েছে), টুনটুন, রানা, রাশিদ, হামজা, আতিক ও কালো। 

রাশেদ আরও জানান, এই ক্যাম্পের ৯টি ব্লক বা সেক্টরের সবকটিতেই চলে মাদক ব্যবসা। ফেনসিডিলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানি রাজু, হেরোইনের ব্যবসা বুনিয়া সোহেল, ইয়াবার ব্যবসা চুয়া সেলিম আর গাঁজার ব্যবসা টুনটুন নিয়ন্ত্রণ করে। টুনটুন বুনিয়া সোহেলের ভাই। 

স্থানীয় কয়েক মাদক ব্যবসায়ী প্রতিবেদককে জানান, তারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তবে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে তারা নেই। তাদের যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এখানকার মাদক ব্যবসায়ীরা থানা, ডিবি, সিআইডি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করেই এই ব্যবসা চালিয়ে আসছে। মোহাম্মদপুর থানা পুলিশকে প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া বাকি সংস্থাগুলোর জন্যও রয়েছে নির্দিষ্ট মাসোহারা। শুধু পুলিশ নয়, মাসোহারা দিতে হয় তাদের নিজেদের সংগঠন এসপিজিআরসিকেও।

আটকে পড়া এই বিহারিদের একমাত্র সংগঠন স্ট্র্যান্ডেড পিপলস জেনারেল রিহ্যাবিলিটেশন কমিটিÑ এসপিজিআরসির সভাপতি এম শওকত আলী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তারা এই সন্ত্রাসী আর মাদক চোরাকারবারিদের কাছে নিজেরাই জিম্মি হয়ে আছেন। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী নেতা এবং পুলিশের মদদে প্রকাশ্যে চলছে এই মাদক ব্যবসা। খুন, ছিনতাইসহ যেসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছে তা এই মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই। এই পরিস্থিতির জন্য পুরোপুরি পুলিশকে দায়ী করে তিনি বলেন, শুধু মদদ নয়, তাদের উপস্থিতিতেই চলছে এসব অপকর্ম। কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারেন না।

শওকত আলী আরও জানান, সারা দেশের ১৩টি জেলায় বর্তমানে তাদের ৭০টি ক্যাম্পে ৬ লাখের (কারও কারও মতে আট লাখ) মতো বিহারি বসবাস করেন। ১৯৯২ সালে এক জরিপে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৮ হাজার, পরিবার ৪২ হাজার। আগে তারা সরকার থেকে রেশন পেত। ২০০৩ সাল থেকে সেটি বন্ধ রয়েছে। তবে তাদের কোনো বিদ্যুৎ ও পনির বিল দিতে হয় না। ঘর ভাড়াও নেই। কিন্তু এরপরও তারা যেভাবে বসবাস করছে, সেটা কোনো মানবিক জীবন হতে পারে না। তাদের দেখভালের জন্য সরকারের একটি বিভাগ রয়েছে। সেটিও এখন অকার্যকর।

এসপিজিআরসির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নাসিম খান। তার ছেলে হারুন আর রশিদ খান বর্তমানে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক। গতকাল তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, মাদক ব্যবসা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে টাকা আদায়ের মিথ্যা অভিযোগ করা হয়। পুলিশের মদদে মোল্লা আসাদ, মোল্লা বশির, চুয়া সেলিম আর বুনিয়া সোহেলের নেতৃত্বেই এখানে মাদক ব্যবসা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছে। তারা নিজেরাও এখন এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি এবং প্রাণভয়ে থাকেন বলে জানান হারুন। 

জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা নিয়ে তেজগাঁও বিভাগের ডিসি রুহুল কবীর খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মাদকের গডফাদারসহ বেশ কয়েকজন মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। 

পুলিশের টাকা নেওয়ার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো তথ্য তার কাছে নেই। সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা