আরমান হেকিম
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১১ এএম
গ্রাফিক্স প্রবা
বিশ্বের যেসব দেশ কারিগরি শিক্ষায় এগিয়েছে তারা শিল্প ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছে। বেকারত্বও নামিয়ে আনতে পেরেছে এক অঙ্কের ভেতরে। বাংলাদেশও সেই চিন্তা ধারণ করে বেকারত্ব কমাতে কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিল। এর মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করতে বেশ কিছু প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় থমকে রয়েছে এসব প্রকল্প। দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বতর্মানে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির উদ্দেশ্যে নেওয়া ১৭টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। যার মধ্যে ১২টি প্রকল্পের অধিকাংশই নেওয়া হয়েছে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে। যার সবই শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের মধ্যে। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও তেমন কোনো কাজ হয়নি। কবে নাগাদ প্রকল্পগুলো শেষ হবে তাও অজানা। অবাক করা বিষয় হলোÑ এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ৪০ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা।
বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামো উন্নত না করে নতুন নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, ভবন নির্মাণে ঝোঁক ছিল নীতিনির্ধারকদের। ফলে প্রকল্প নেওয়ার আগে সঠিকভাবে সম্ভাব্য সমীক্ষা করা হয়নি। এতে বেশিরভাগ প্রকল্পই ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় আটকে আছে। এ ছাড়া বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত অনেকের প্রকল্প সম্পর্কে জ্ঞান ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। যার কারণে অদক্ষতায় ধুঁকছে প্রকল্প।
সূত্র জানায়, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন সবচেয়ে বড় বাজেটের প্রকল্প হলোÑ উপজেলা পর্যায়ে ৩২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপন। ২০ হাজার ৫২৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি একটি করে কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয় সুবিধা সৃষ্টি করা। এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্স চালু করার মাধ্যমে দেশব্যাপী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সম্প্রসারণ।
প্রকল্পটির সাড়ে তিন বছর পেরুলেও তেমন কোনো কাজ হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক ড. মশিউর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত ১২টির ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। ৬টির ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে।’
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাজেটের প্রকল্প হলোÑ অ্যাকসেলারেটিং অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং স্কিলস ফর ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন (এএসএসইটি) শীর্ষক প্রকল্প। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৯৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে সরকারের ব্যয় ১ হাজার ৭১৯ কোটি ৯৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা। আর বিশ্বব্যাংকের (আইডিএ) ২ হাজার ৫৮০ কোটি ৩১ হাজার টাকা। প্রকল্পটির উদ্দেশ্যÑ শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভবিষ্যৎ কর্মে প্রযুক্তির ব্যবহারের দক্ষতা যুবসমাজের জন্য নিশ্চিত করা এবং শ্রমবাজারে নারী ও সুবিধাবঞ্চিতদের অবদানের হার বৃদ্ধি করা।
অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। ৩ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু বর্ধিত সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় আরও তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এতে তিন বছরের প্রকল্প গিয়ে ঠেকেছে ৭ বছরে। কিন্তু প্রকল্পের কাজের যে অগ্রগতি তাতে সংশোধিত মেয়াদেও কাজ শেষ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
তা ছাড়া ভূমি জরিপ কাজে জনবল সংকট নিরসন ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে চার উপজেলায় ভূমি জরিপ শিক্ষার উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটি কুমিল্লা সদর, রাজশাহী সদর, পটুয়াখালী জেলার দশমিনা ও যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে।
চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর চার বিভাগে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন শীর্ষক তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটিতে শুধু ভূমি অধিগ্রহণেই লেগেছে ৫ বছর। ৬ বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে ৮৬ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফয়সাল মুফতি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের সবগুলোর জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে প্রশাসনিক ভবনের বেজমেন্টের কাজ চলছে।’
একই অবস্থা সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগীয় শহরে চারটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্পে। ৬ বছরে প্রকল্পটির অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ।
এ ছাড়া ‘২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নাগরিকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয়। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬৫৩টি মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন। মাদ্রাসা এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম সাপোর্ট স্থাপন প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১ কোটি ১২ লাখ ৬১ হাজার টাকা ও নির্বাচিত মাদ্রাসাসমূহের উন্নয়ন প্রকল্প। যার ব্যয় ধরা হয় ৬ হাজার ৩৪৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এসব প্রকল্পের অবস্থাও বেহাল। ২০২২ সালের মধ্যে এগুলো বাস্তবায়নের কথা থাকলেও এখনও তা সম্ভব হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আজিজ তাহের খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার পেছনে জমি অধিগ্রহণই প্রধান সমস্যা বলা যাবে না। একেক জায়গায় একেক সমস্যা থাকতে পারে। জমি অধিগ্রহণে অর্থছাড় বন্ধ থাকলে কাজের কিছুটা ব্যাঘাত ঘটবেÑ এটা স্বাভাবিক।’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের কারিগরি শিক্ষায় আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কর্মমুখী শিক্ষা না থাকায় অনেকেই লেখাপড়া শেষ করেও চাকরি পাচ্ছেন না। অথচ যারা কারিগরি শিক্ষাগ্রহণ করছে তারা বসে থাকছে না।’
সম্প্রতি এক সংলাপে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো বিদ্যমান, সেগুলোর সমাধান না করে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা কোনো সমাধান নয়। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কেমন হবে, তা নির্ভর করবে শিক্ষার্থীদের কেমন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে তার ওপর। বাজার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’