রাজবংশী রায় ও রানা হানিফ, ঢাকা
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২২ ২২:১৩ পিএম
আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২২ ১৩:৩৭ পিএম
একটি দোকানে ওষুধ কিনছেন ক্রেতারা। ছবি : সংগৃহীত
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সি আবদুল মান্নান দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট ও হাড় ক্ষয়জনিত রোগে ভুগছেন। এজন্য তাকে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট প্লাস ভিটামিন ডি৩ গ্রুপের কোরালক্যাল-ডিএক্স ৬০০ মিলিগ্রাম বড়ি প্রতিদিন দুটো করে এবং মন্টিলুকাস্ট সোডিয়াম গ্রুপের মোনাস ১০ মিলিগ্রাম বড়ি একটি করে সেবন করতে হয়।
আবদুল মান্নান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘গত মাসেও কোরালক্যাল-ডিএক্স প্রতি পিস ১৪ টাকা করে কিনেছি। এক মাসে এই ওষুধের পেছনে আমার খরচ ছিল ৮৪০ টাকা। কিন্তু চলতি নভেম্বরে ওষুধটির দাম ২ টাকা করে বেড়েছে। এখন এক মাসের ওষুধ কিনতে খরচ হচ্ছে ৯৬০ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে এই এক ওষুধের পেছনে তার ব্যয় বেড়েছে ১২০ টাকা।’
এদিকে অনেক রোগী কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস চেপে ফার্মেসির সামনে থেকে শূন্য হাতে ফিরছেন। কেউ কেউ সামান্য ওষুধ কিনলেও বাকিগুলো খাওয়া ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। তবে বিপাকে রয়েছেন যাদের জীবন রক্ষাকারী অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ প্রতিদিনই প্রয়োজন হয়। আবদুল মান্নান বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বাড়ায় আরও চাপে পড়তে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ায় মাছ-মাংসসহ অনেক পুষ্টিকর ও দামি খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে এক দিন মাংস খাওয়ার পরিবর্তে মাসে এক দিন খাওয়া যাবে। কিন্তু সুস্থ থাকতে হলে প্রয়োজনীয় ওষুধতো খেতেই হবে।’
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি হঠাৎ জীবনরক্ষাকারী অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছে আবদুল মান্নানের মতো বহু মানুষ।
রাজধানীর মিটফোর্ড, শাহবাগ ও কলাবাগানে ওষুধের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, ঠান্ডা-কাশি, অ্যালার্জেটিক ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় বহুল ব্যবহৃত ওষুধ রেনেটা লিমিটেডের ফেনাডিন (ফেক্সোফেনাডিন হাইড্রোক্লোরাইড) ১২০ মিলিগ্রাম বড়ি এক মাস আগেও প্রতি ১০ পিস বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। বর্তমানে এ ওষুধটির দাম বেড়ে হয়েছে ৯০ টাকা। ওষুধটি এক মাসের ব্যবধানে প্রতি পিসের দাম বেড়েছে ১ টাকা করে।
একই জেনেরিকের ইউনাইটেড ফার্মাসিউটিক্যালের অ্যাডিফেক্স ১২০ মিলিগ্রাম বর্তমানে প্রতি পিসের দাম দেড় টাকা বেড়ে সাড়ে ৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে। একমি ল্যাবরেটরিজের অ্যালানিল ১২০ মিলিগ্রাম বড়ির দামও প্রতিটি ১ টাকা বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা। স্কয়ার ফার্মার ফেক্সো ১২০ মিলিগ্রাম বড়ির দামও ১ টাকা বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা।
ঠান্ডা জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা, মাথাব্যথা ও বাতজনিত ব্যথায় বহুল প্রচলিত সব কোম্পানির অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধেরও দাম বেড়েছে। ফার্মাদেশ ল্যাবরেটরিজের এনজিন ৫০ মিলিগ্রাম ওষুধের দাম প্রতি ১০টিতে বেড়েছে ৫ টাকা। স্কয়ার ফার্মার কারভা ৭৫ মিলিগ্রাম ২০০টির প্যাকেটের দাম ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ১৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। একমি ল্যাবরেটরিজের ৭৫ মিলিগ্রাম একোসপ্রিনের দাম প্রতিটিতে ৩০ পয়সা করে বেড়ে বর্তমানে ৮০ পয়সা করে বিক্রি হচ্ছে।
ডায়াবেটিক পেরিফেরাল ও স্পাইনাল কর্ডের আঘাতজনিত স্নায়ুবিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় প্রিগাবালিন গ্রুপের ওষুধ। অপসোনিন ফার্মার ১৫০ মিলিগ্রাম প্রিগাবা ক্যাপসুলের প্রতি পিসের দাম ৩৩ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। রেনেটার গাবা-পি সিআর ১৬৫ মিলিগ্রাম বড়ির দামও প্রতি পিসে বেড়েছে ৩ টাকা করে। বর্তমানে এই ট্যাবলেটটি বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ৩৫ টাকা করে।
স্নায়বিক ও রক্তনালির রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত টোলপেরিসোন হাইড্রোক্লোরাইড গ্রুপের ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের মায়োলাক্স, একমির এ-কাল্ম, অপসোনিনের টলসন, বেক্সিমোর টলমাস ওষুধের দাম আগের তুলনায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ করে বেড়েছে। উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যা, রক্তের প্রোটিন, ইউরিয়াসহ টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর কিডনি সমস্যার চিকিৎসায় ব্যবহৃত লোসারটান পটাশিয়াম গ্রুপের ওষুধের দামও কোম্পানিভেদে ১০-১৫ শতাংশ বেড়েছে। স্কয়ার ফার্মার এনজিলক ৫০ মিলিগ্রাম আগে বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস ৮ টাকা করে। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা করে।
রাজধানীর অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের ফলে ঠান্ডা, কাশিসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগে প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে এ ধরনের রোগের উপসর্গ বেশি দেখা দিয়েছে। প্রতিবছরই এ সময়গুলোতে ফেক্সোফেনাডিন হাইড্রোক্লোরাইড, অ্যাসপিরিন ও ব্রোমহেক্সিন হাইড্রোক্লোরাইড গ্রুপের ওষুধেরও চাহিদা বেড়ে যায়।
অপরদিকে দেশের পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে ডায়াবেটিস, কিডনি, স্পাইনাল কর্ড ও উচ্চরক্তচাপজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি থাকায় অতিপ্রয়োজনীয় প্রিগাবালিন, টোলপেরিসোন হাইড্রোক্লোরাইড ও লোসারটান পটাশিয়াম জাতীয় ওষুধগুলোর সবসময়ই চাহিদা রয়েছে। হঠাৎই সব ধরনের ওষুধের দাম গত এক মাসে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
মিটফোর্ডের একটি ওষুধের দোকানের বিক্রয়কর্মী রাসেল মাহমুদ জানান, ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, হাড় ক্ষয়, কিডনিজনিত সমস্যাসহ আরও কিছু রোগের বেশ কিছু ওষুধ আছে, যা রোগীদের নিয়মিত সেবন করতে হয়। অনেকেই এ ধরনের অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ একসঙ্গে ১৫ দিন থেকে এক মাসের জন্য কিনে বাড়িতে মজুদ রাখেন। এ ধরনের ওষুধের দামও ক্রেতার জানা থাকে। কিন্তু দেখা যায়, একজন ক্রেতা যখন ১৫ দিন বা এক মাস পরে ওষুধগুলো কিনতে আসেন, তখন দাম বাড়ার কারণে তারাও অপ্রস্তুত হয়ে যান।
এর বাইরেও স্যালাইনসহ বেশ কিছু ওষুধের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত ২০ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সূত্র জানায়, দেশের শীর্ষ স্যালাইন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান লিবরা ইনফিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্যালাইনের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে নতুন দাম কবে থেকে কার্যকর হবে তা এখনও জানানো হয়নি। লিবরা ইনফিউশনের ২৩টির মতো স্যালাইন পণ্য রয়েছে বাজারে। এগুলো প্রতি প্যাকেট ৩৫ থেকে ১৪৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। গত মাসে এসএমসির ওরস্যালাইনের দাম প্রতিটি ১ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ মোড়ের ইএস ফার্মার বিক্রয়কর্মী মো. আশিকুর রহমান জানান, এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের ওষুধের দাম প্রকারভেদে ২ থেকে ৩ টাকা করে বেড়ে গেছে।
আশিক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, অক্টোবর মাসের শুরু থেকে কোম্পানিগুলো ঠান্ডা-কাশিজনিত রোগের ওষুধের সরবরাহ কমিয়ে আনে। অথচ তখন এসব ওষুধের চাহিদা থাকে অনেক। এরপর নভেম্বরের শুরু থেকেই কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়াতে শুরু করে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আশরাফুল হক বলেন, কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি আইভি ফ্লুইডের দাম বাড়ানোর জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু কারণ দেখিয়ে স্যালাইনসহ কয়েক ধরনের ওষুধের দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু ওষুধের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে।
এর আগে গত জুনে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি ওষুধের দাম ১৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। ডলার সংকটের কারণে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানিতে কিছুটা প্রভাব পড়ছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এ কারণে ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক জাকির হোসেন রনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি করা কাঁচামালের দাম বেড়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু যেভাবে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে তা অযৌক্তিক। কারণ মূল্যবৃদ্ধির আগে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। অনেক ওষুধ আছে, যা সারা জীবন সেবন করতে হবে। অথচ সেই সব ওষুধের দাম ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আবম ফারুক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, দেশে বর্তমানে ৩ হাজার ২০০ জেনেরিকের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ১১৭টি জেনেরিকের ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের কাছে আছে। আর বাকি ওষুধের মূল্য কোম্পানিগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নির্ধারণ করে থাকে। তবে সেটি আসলে রুটিন ওয়ার্ক। সরকারের তেমন কিছু করণীয় নেই। কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাতেই দাম বাড়ে।
অধ্যাপক ফারুক বলেন, ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা একটি চিঠির কারণে ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যায়। ওই চিঠিতে বলা হয়, জীবনরক্ষাকারী ১১৭টি ওষুধের মধ্যে যেসব কোম্পানি ৮০ শতাংশ উৎপাদন করবে তারা নিজেরা মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা পাবে।
এ ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন উল্লেখ করে আবম ফারুক বলেন, প্রতিবছর ওষুধের মূল্য বাড়ার পর একটি বিতর্ক তৈরি হয়। এটি নিরসনে সরকার, ওষুধ কোম্পানি, ভোক্তা, চিকিৎসক, ওষুধ বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটি সার্বিক বিষয় যাচাই-বাছাই করে ওষুধের মূল্য নির্ধারণের প্রস্তাব করবে। এর আলোকে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। তাহলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের মাত্র ১১৭টি ওষুধের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাকি ওষুধের দাম ওষুধ কোম্পানিগুলোই নির্ধারণ করে। যদিও মূল্য নির্ধারণ হয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনসাপেক্ষে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে মূল্যবৃদ্ধির আবেদন করা হলে তারা প্রথমে তা যাচাই করে দেখেন। ওই আবেদন যৌক্তিক হলে মূল্য বাড়ানো হয়। এটা আসলে রুটিন ওয়ার্ক।