আরমান হেকিম
প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৪ ১১:০০ এএম
সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি কোনো নতুন বিষয় নয়। প্রায়ই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোনোর মতো বড় বড় প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতির খবর সংবাদ শিরোনাম হয়ে হইচই ফেলে দেয়। ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সিগন্যালিংসহ রেললাইন সংস্কার ও নির্মাণ’ প্রকল্পটিও যেন তেমনই একটি নজির। এই প্রকল্পে অনিয়মের মাত্রা এতই বিশাল যে সেটা শুনলে যে কারও চোখ কপালে উঠে যাবে! ৩৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে ৩১৮ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৯৫ শতাংশ। অডিট অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, প্রকল্পটি শেষ হয়েছে ২০২২ সালে। কিন্তু এই প্রকল্প নিয়ে উত্থাপিত আপত্তিগুলোর নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো তোড়জোড়ও দেখা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. আসাদুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। যেসব আপত্তি উঠেছে সেগুলো বড় কোনো বিষয় নয়। যেমনÑ একটি আপত্তি রয়েছে অতিরিক্ত ওজনের রেললাইন ক্রয় করা নিয়ে। বাস্তবতা হলো, এই পথে ভারি মালামাল পরিবহন করা হয়। এখানে কম ওজনের রেললাইন করলে হবে না। এটি টেকনিক্যাল বিষয়। যারা অডিটে এসেছেন তাদের বোঝার কথা না। তাই আপত্তি তোলা হয়েছে।’
জানা গেছে, অডিট অধিদপ্তর প্রকল্পটির ২০১৮-১৯ অর্থবছরের কাজের ওপর ২০২০ সালের আগস্ট মাসে অডিট পরিচালনা করে। অডিটে ৩১৮ কোটি ৯৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা অনিয়মের কথা উঠে আসে।
আপত্তির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) অনুমোদিত রেটের অতিরিক্ত রেটে প্রাক্কলন ও চুক্তি করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৪৫ কোটি ৩২ লাখ ৫৬ হাজার ৫২০ টাকা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৩ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন রেল ও ২৪ হাজার ৮২৭টি স্প্রেয়ার কিনে ৮০ কোটি ৭৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে। রেগুলার রেললাইন না হলেও অতিরিক্ত ওজনের রেললাইন কিনে ও ব্যবহার করে ১১ কোটি ৩১ লাখ ৮১ হাজার ২৫০ টাকা অপচয় করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের (তৎকালীন) নির্দেশনা উপেক্ষা করে কাজের আগেই ঠিকাদারকে ২৯ কোটি ৭৫ লাখ ৫৭ হাজার ৪৫০ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নকালে মাটির কাজে স্রিংকেজ বাদ না দেওয়ায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। রোড ডিভাইডারের কাজে রেট শিডিউলের অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করায় ক্ষতি হয়েছে ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৯৫০ টাকা। দরপত্র দলিলের শর্ত মোতাবেক টেস্ট রিপোর্ট ছাড়াই স্টোন ব্যালাস্টের সরবরাহ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ৩ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া মেজারমেন্ট বুকে সমাপ্ত কাজের পরিমাণ এন্ট্রি না করেই ১৫০ কোটি ২৫ লাখ ৩১ হাজার ৪৭৫ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
অডিট আপত্তি নিয়ে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘অডিটে যেসব আপত্তি উঠে আসে তার বেশিরভাগই সাধারণত নিষ্পত্তি হয়ে যায়। তাই এখানে দুর্নীতি হয়েছে কি না সেটা প্রমাণিত নয়। তবে কথা হচ্ছে, মোট ব্যয়ের ৯৫ শতাংশই আপত্তির বিষয় হয় কীভাবে? কাজেই এখানে যদি কোনো ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
ডিপিপি সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মালামাল পরিবহনের জন্য ঈশ্বরদী বাইপাস টেক অফ পয়েন্ট থেকে ঈশ্বরদী রেলস্টেশন হয়ে পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর এলাকা পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ (ব্রড গেজ ও মিটার গেজ) রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় রূপপুরে রেলস্টেশন, ১৩টি লেবেল ক্রসিং গেট, একটি প্ল্যাটফর্ম, ৭টি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি এ প্রকল্পের মধ্যেই ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের দুই পাশজুড়ে লুপ লাইন সংস্কার, প্লাটফর্ম উঁচু করা এবং ঈশ্বরদীর রিলে ইন্টারলকিং বাদ দিয়ে কম্পিউটারাইজ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এই রেললাইন নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৩৩৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে এক বছর অতিরিক্ত সময় লেগেছে।
প্রসঙ্গত, রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় রূপপুরে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশন। এ প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু সংস্থা রোসাটমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট।
পরিকল্পনা অনুসারে প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা ছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। আর গত বছর ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা ছিল। এরপর এটি পিছিয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায়ের কাজ উদ্বোধন করা হয়। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে।