প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪ ১২:১৪ পিএম
কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকায় গোমতী নদীর পূর্বপাড়ে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। হু হু করে লোকালয়ে প্রবেশ করছে বন্যার পানি। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে মানষি। শুক্রবার দুপুরে উপজেলার ইছাপুরায়। আরিফুল আমিন
ফেনী ও সিলেটসহ দেশের কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যার বিষয়ে এক মাস আগে থেকেই সতর্কতা ছিল। তবে যে মাত্রায় বন্যা হচ্ছে এ নিয়ে প্রাথমিক সমীক্ষা ছিল না। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেও বন্যা মোকাবিলায় যা করণীয় তার গতি কিছুটা হলেও স্তিমিত রয়েছে। ফলে পূর্বাভাস থাকলেও আকস্মিক এবং প্রবল মাত্রার বন্যার জন্য প্রস্তুতি নেওয়াটা ‘কঠিন’ ছিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, আকস্মিক এ বন্যার বিষয়ে অন্তত তিন দিন আগে থেকে সতর্কতা ছিল এবং বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করার পূর্বাভাসও ছিল বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের। গত ২ জুলাই শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক। ওই বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যার বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বন্যা হতে পারে, পূর্বাভাস সে রকম পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৮ আগস্ট দেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে শুধু নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। ভারতের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকেও এমন তথ্য জানানো হয়নি। ফলে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল। অন্যদিকে বন্যা নিয়ে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের গাফিলতিকেও দুষছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, গত বছর থেকে বলা হচ্ছিল লা নিনার প্রভাবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে বড় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। গত জুনের শেষে ও জুলাই মাসজুড়ে দেশের সিলেট, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় স্বাভাবিক বন্যা চলে আসছিল। তা ছাড়া গত জুলাইয়ের শুরুতেও বন্যার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয় সরকারের উচ্চ মহলে। কিন্তু জুলাইয়ে দেশব্যাপী শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বন্যার বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়নি। প্রশাসনকে পুরোপুরি রাজনীতিকরণ করাটাই এই অবস্থার জন্য দায়ী।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, গত সপ্তাহ থেকেই ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যেসব জায়গায় বৃষ্টি হবে, এমনকি কক্সবাজারসহ ওই অঞ্চলে পাহাড় ধসের কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এ বছর বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হবেÑ এমন পূর্বাভাস মে মাসে অনুষ্ঠিত আবহাওয়াবিষয়ক এক সম্মেলনে দেওয়া হয়েছিল।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী মো. জাকির হোসেন খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রশাসনকে রাজনীতিকরণের যে ফল তা আমরা দেখতে পারছি। দেশে যদি জবাবদিহি থাকত, দায়বদ্ধতা থাকত; তাহলে আজকে এমন পরিস্থিতি দেখতে হতো না। সরকার পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু প্রশাসনিক কাজ তো চলমান থাকবে। আমলাতন্ত্র তো থাকবে। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের যে সমন্বয় থাকার কথা ছিলÑ সেটি কেন থাকল না; তাও অনুসন্ধান করে দেখা উচিত।
তিনি আরও বলেন, জয়েন্ট রিভার কমিশন অ্যাকটিভ না। এখন ভারতের বৃষ্টির বা বন্যার যে পূর্বাভাস তারা দিচ্ছে সেটি সময়মতো আমাদের কাছে আসছে নাকি আসছে নাÑ সে কথাটি আমাদের বলতে হবে। আমরা দেখলাম ভারত থেকে পানি আসবে সে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। গত বছর থেকেই জানতাম এল নিনোর প্রভাবে এখানে বন্যা হবে। বন্যার সময় পানি কোন পর্যায় পর্যন্ত আসবে বা কতটুকু পানি হলে ড্যাম খুলে যাবে কিংবা ধারণক্ষমতা কত সেটি ভারত জানায়নি। সে কাজটি কেন তারা করেনি সে প্রশ্নও তুলতে হবে। আর আমাদের এখানে তথা ফেনীতে বন্যা হলে প্রস্তুতিটা কেমন হবে, আমাদের ব্যবস্থাপনা কেমন হবেÑ সেটির এসেসমেন্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড করেছে কিনা; তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেছেন, গত জুলাই মাসের ২ তারিখে যখন প্রস্তুতি নিতে বলা হচ্ছিল; তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় ধরনের বন্যা দেখা দিয়েছিল। সিলেট ও কুমিল্লায়ও বন্যা চলছিল। তবে এখন যে বন্যাটি হচ্ছে সেটি অপ্রস্তুতভাবে পানি আসার কারণে হয়েছে। এখন বন্যা মোকাবিলায় সমান্তরালভাবে চিন্তা করতে হবে দুর্যোগ মন্ত্রণালয় ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কারণ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রচুর নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রয়েছেন। তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, বন্যা অতি প্রবলমাত্রার হয়েছে। আর আকস্মিক বন্যার ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ডই ‘এক দিনের লিডটাইম’। সেই হিসাবে আসলে প্রস্তুতি নেওয়া এমনিতেই কঠিন। যদি খুবই বড় মাত্রার বন্যা হয়; তবে এক দিনের প্রস্তুতি যথার্থ নয়। এটা আসলে গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের নানা জায়গাতেই আকস্মিক বন্যা হচ্ছে। এ ধরনের বন্যায় অনেক অনিশ্চয়তা থাকে। সাধারণত সর্বোচ্চ তিন দিনের বেশি সময় ইফেক্টিভলি পাওয়া যায় না। অন্তত তিন দিন আগে থেকেই ওয়ার্নিং ছিল। এক দিন আগে ফোরকাস্ট দেওয়া ছিল যে, ডেঞ্জার লেভেল ক্রস করবে। আমাদের যে ইনিশিয়াল এস্টিমেশন ছিল তার তুলনায় বন্যাটা তীব্র হয়েছে। আমরা যে পরিমাণ পানি ধারণা করেছিলাম তার থেকে বেশি এসেছে। ফলে বন্যাটা অতি চরম আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া মৌসুমি লঘুচাপের কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। সাগরের জোয়ারের লেভেল হাই ছিল। সব মিলিয়ে বন্যাটা তীব্র হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর সাতটি নদীর ১২টি পয়েন্টে পানি এখনও বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানি কমার ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২৫ আগস্টের মধ্যে পানি কমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। মানুষকে রক্ষা করার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। আমাদের সঙ্গে জেলাপ্রশাসন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং ছাত্ররাও কাজ করছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসে সাধারণত দেশের পূর্বাঞ্চলে এত ভারী বৃষ্টি হয় না। বিশেষ করে মাসের শেষের দিকে টানা বৃষ্টি হলেও তা দেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে মধ্যাঞ্চলজুড়ে থাকে। আগস্টে এর আগেও ফেনী ও কুমিল্লায় অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু তা এক বা দুই দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে গত এক মাসে থেমে থেমে অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ জেলায় ১০০ থেকে ২০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও ভারী বৃষ্টি হয়েছে।
পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পূর্বাভাস
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে এই সময়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবি) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
গতকাল শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল ধীরগতিতে হ্রাস পাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় জেলা কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনীতে ভারী বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি। যার ফলে উজানের নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পেতে শুরু হয়েছে। বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির ধীরগতিতে উন্নতি হচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদসমূহের সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এ ছাড়াও আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এতে উল্লিখিত সময়ে এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা ইত্যাদি নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র আরও জানিয়েছে, বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে। যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। পাশাপাশি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় হ্রাস পেতে পারে। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চলের দুধকুমার, তিস্তা ও ধরলা নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এসব নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিরাজমান থাকতে পারে।