প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৪ ১০:২৪ এএম
ভয়াবহ বন্যার কবলে বাংলাদেশ। প্রবা ফটো
অবিরাম ভারী বৃষ্টি আর উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দেশের পূর্বাঞ্চলের আটটি জেলা। জলবন্দি হয়ে পড়েছে আট জেলার চার লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার। বাংলাদেশের নদী গবেষক ও সংরক্ষণকর্মীদের একটি অংশের দাবি, এবারের বন্যার পেছনে রয়েছে পানি রাজনীতি। অভিযোগ উঠেছে, ভারত আগে থেকে সতর্ক না করেই বাঁধ খুলে দেওয়ায় ভয়াবহ বন্যার ঘটনা ঘটেছে। পানি রাজনীতির প্রয়োগ ঘটাতে বাঁধ খুলে দেওয়ার অভিযোগ তুলে গত বুধবার থেকে দেশের শিক্ষার্থী-জনগণ ব্যাপক সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে কথা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও। এ সময় দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে উপদেষ্টাদের নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশের পর্যবেক্ষকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, বাঁধ কখন খোলা হচ্ছে বা আটকানো হচ্ছে, ভারতের তরফ থেকে তা কখনও জানানো হয় না। তারা বলছেন, ভারতের ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫০ উপজেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন বন্যা প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার এই খবর নাকচ করে দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
কী বলছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা
এদিকে পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘উজানের পানি বাংলাদেশে ধেয়ে এসে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।’ তিনি বলেন, ‘কোনোরকম আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। বাঁধ খুলে দেওয়ার মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে।’ তিনি ‘বাংলাদেশের জনগণবিরোধী এই ধরনের নীতি’ থেকে ভারতকে সরে আসার আহ্বান জানান।
তবে ত্রাণ ও দুর্যোগ উপদেষ্টা ফারুকী আজম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যার কারণ হিসেবে ভারতে বাঁধ খুলে দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়ে দেশটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’ ভারত বাঁধ খুলে দিয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সঠিকভাবে বলতে পারছি না। শুনেছি ওপরে বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। বাঁধ খোলা হয়েছে এটা পত্রপত্রিকায় লিখেছে, বিভিন্ন মাধ্যমে আসছে। সরকারিভাবে বিস্তারিত জানি না।’
যা বলছেন নদী বিশেষজ্ঞরা
উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে নদীবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভারাইন পিপলের প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব শেখ রোকন ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘মুহুরী নদীতে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার কলসিতে একটি ব্যারাজ রয়েছে। মুহুরী অববাহিকার উপনদীগুলোতেও রয়েছে একাধিক ড্যাম। এবারের অতিবৃষ্টির বন্যা যে ড্যাম-ব্যারাজ খোলার জন্যই বিপর্যয়কর হয়েছে, সেটা বোঝা যায় স্রোত দেখে। স্বাভাবিক বন্যার পানি নদীতে স্রোত তৈরি করতে পারে, মাঠে ও বসতিতে স্রোত তৈরি করার কোনো কারণ নেই। এবারের বন্যা কতটা বিপর্যয়কর হয়েছে, পানি নেমে যাওয়ার পর আরও বেশি বোঝা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘গোমতীর ডম্বুর ড্যাম বা মুহুরীর কলসি ব্যারাজ থেকে পানি ছাড়ার আগে উজানের দেশ ভারত ভাটির দেশ বাংলাদেশকে আগাম সতর্ক করেনি। এটা ঠিক, বৃষ্টিপাত ও বন্যার আগাম তথ্য বাংলাদেশকে জানিয়ে থাকে। কিন্তু ডম্বুর-কলসি ব্যারাজ বা ড্যাম খুলে দেওয়ার তথ্য বাংলাদেশকে জানায়নি।... ড্যাম বা ব্যারাজ খুলে দিলে তিন দিনের বন্যা তিন ঘণ্টার ঘনত্বে চলে আসে। আর যদি ভাটির দেশকে না জানিয়ে ব্যারাজ ছাড়া হয়, তাহলে বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি ও দুর্গতদের উদ্ধার তৎপরতার সময়ও থাকে না। জান ও মালের ক্ষতি অনেক বেশি হয়। এবার সেটাই ঘটেছে।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘ভারত যেটা জানিয়েছে, সেটা হলো বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য। অভিন্ন নদী অববাহিকায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য পরস্পরকে জানানোর বিষয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তিও রয়েছে। যেমন, ব্রহ্মপুত্রের তথ্য চীন আমাদের জানিয়ে থাকে। যেমন, আত্রাই বা পুর্নভবা নদী অববাহিকার দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁওয়ে অতিবর্ষণ বা বন্যা হলে আমরা ভারতকে সতর্ক করি; যাতে করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর বা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রস্তুতি নিতে পারে। এই ক্ষেত্রেও ভারত ত্রিপুরায় অতিবৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য জানিয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল, সুনির্দিষ্টভাবে ডম্বুর ও কলসি ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য কি ভারত জানিয়েছিল? উত্তর হচ্ছে, না। ভারতীয় পররাষ্ট্র বা আবহাওয়া দপ্তরও সেটা দাবি করেনি। এই যে ড্যাম বা ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি, সেটাই বন্যাটিকে বিপর্যয়কর করে তুলেছে।’
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পানি রাজনীতির দিকে ইঙ্গিত করে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘দিল্লির জন্য ত্রিপুরাকে কষ্ট দিয়ে হলেও বাংলাদেশকে পানিতে ডোবানোটা এখন গুরুত্বপূর্ণ।’
এ প্রসঙ্গে সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বাংলাদেশি বাতেল মোহাম্মদ এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘পানি রাজনীতি খুব জটিল। এটা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে হিন্দু-মুসলিম বাইনারি উসকে দেওয়ার ভ্রান্ত রাজনীতি না।... যতগুলো রাজনীতি আছে তার মধ্যে পানি রাজনীতি সবচেয়ে এডুকেটেড ও ইন্টেলিজেন্ট রাজনীতি।’ তিনি লিখেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪। ভাটির দেশ হিসেবে এইসব আন্তর্জাতিক নদীতে আমাদের পানি প্রাপ্তির অধিকার আন্তর্জাতিক নানা আইন দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা সেসব আইনকে এক্সেপ্ট করেছি কি না? হেলসিংকি প্রিন্সিপাল আমরা কতটুকু পালন করছি? ১৯৯৬ সালের নন-নেভিগেশনাল ওয়াটার অ্যাক্ট আমরা স্বাক্ষর করেও অনুসমর্থন কেন করছি না? অথচ এটাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পানিসংক্রান্ত বণ্টনের সবচেয়ে বড় আইন। যে আইন ভারত স্বাক্ষর করেইনি। আমরা স্বাক্ষর করেও ভারতের চাপে অনুসমর্থন করিনি। ভারতকে পানির বণ্টনে বাধ্য করতে আমরা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বাইরে বহুপক্ষীয় আলোচনায় টেনে নিতে না পারার ব্যর্থতা কাদের?’
গবেষক বাতেল মোহাম্মদের মতে, ‘জলকপাট খুলে দেওয়ায় বন্যা হয়েছে এটা অতি সরলীকরণ। উজানে পানি বাড়লে এমনিতেও বাঁধ ভেঙে যেত। তাতে ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি বই কম হতো না। উজানে ভারীবষর্ণ, পূর্ব হিমালয়ের হিমবাহ দ্রুত গলাসহ নানা কারণেই আমাদের অবস্থান নাজুক। এইসব কারণে শুধু ভাটি না, উজানও ক্ষতিগ্রস্ত।... এইবারের বন্যায় যত না জলবিদ্যুতের বাঁধ দায়ী, তার থেকেও বেশি দায়ী অতিবৃষ্টি, হিমবাহ গলে যাওয়া। এইগুলোর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। তথ্য, উপাত্ত ও আগাম বন্যা ব্যবস্থাপনা জোরদার করা। মহুরী নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আইনুর নিশাত স্যারের নেতৃত্বে কারিগরি কমিটি যে সুপারিশ করেছিল সেটা বাস্তবায়ন করলে বন্যার প্রকোপ হয়তো কমত না, কিন্ত ক্ষয়ক্ষতি হয়তো কিছুটা কমত।’
রাজনীতিকরা যা বলছেন
ভারত কৃত্রিমভাবে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, এমন দাবি করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল বিকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রতিবেশী দেশটি অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহে নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমাদের দেশের স্বার্থকে বিপন্ন করছে। উদ্দেশ্যসচেতনভাবেই বাঁধের গেট খুলে দেওয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশের মানুষ মনে করে।’
বাংলাদেশের ফেনী ও নোয়াখালীর বন্যাকে ‘ভারতের রাজনৈতিক বন্যা’ আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করা হবে বলে মন্তব্য করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা সাজেদুর রহমান বলেন, ‘ভারত আমাদের ওপর আবারও রাজনৈতিক বন্যা চাপিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসারে উজানের দেশ কখনও অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীতে এমন কোনো বাঁধ দিতে পারে না, যা ভাটির দেশের নদীব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু ভারত আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক অভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে আমাদের নদীব্যবস্থা ও কৃষিব্যবস্থা দুটোরই ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। এসব বাঁধ ও বন্যা সৃষ্টি ভারতের আন্তর্জাতিক অপরাধ।’
গতকাল লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে পানিবন্দি দুর্গত বাসিন্দাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণকালে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী দেশ (ভারত) শুকনো মৌসুমে পানি আটকিয়ে রাখে। আর বর্ষার সময় একসঙ্গে সব গেট খুলে দেয়।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েক নেতাও ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়াকে এই বন্যার কারণ বলে বর্ণনা করেছেন। গত বুধবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে গিয়ে সংগঠনটির অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। বাঁধ খুলে দিয়ে দেশের মানুষকে সংকটে ফেলেছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ
ভারতে ডম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ার প্রতিবাদে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ভোলা ও মাধবপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক-কর্মীরা। এ ছাড়া পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতে বাঁধ খুলে দেওয়ার প্রতিবাদে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে।
বেরোবি প্রতিবেদক জানান, বিক্ষোভ সমাবেশে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আহসান হাবিব বলেন, ‘আন্তর্জাতিক নদী আইন না মেনে ভারত অবৈধভাবে ফারাক্কা বাঁধ, ডম্বুর বাঁধ ও তিস্তা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত করেছে।’
রাবি প্রতিবেদক জানান, বিক্ষোভে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘প্রতিবেশীর সঙ্গে সব সময় সুসম্পর্ক রাখতে হয়। তবে এটি হতে হবে দ্বিপক্ষীয়। আমাদের বিগত সরকার নতজানু একটা পররাষ্ট্রনীতি করেছে।’
পবিপ্রবি প্রতিবেদক জানান, বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বাঁধ খুলে দিয়ে মানব বিপর্যয় সৃষ্টির প্রতিবাদ জানান। এ সময় আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদের শিক্ষার্থী নুরুন্নবী সোহান বলেন, ‘বারবার ভারতের এমন আগ্রাসন আমরা নিতে পারি না। ভারতকে তাদের নীতি থেকে সরে আসতে হবে।’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য
ভারতের ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছেÑ বাংলাদেশে এমন একটি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এটা বাস্তবে সঠিক নয় বলে দাবি করেছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল দেশটির মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি করে বলা হয়, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর অববাহিকা (ক্যাচমেন্ট) এলাকায় কয়েক দিন ধরে এ বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে এ বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকের বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে।’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে বেশ দূরে ১২০ কিলোমিটারেরও বেশি উজানে ডম্বুর বাঁধের অবস্থান। এটা কম উচ্চতার (প্রায় ৩০ মিটার) একটি বাঁধ। এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একটি গ্রিডে যুক্ত হয় এবং ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে যায়। প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীর অববাহিকায় তিনটি জায়গায় (অমরপুর, সোনামুড়া ও সোনামুড়া-২) পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশন রয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, গত বুধবার (২১ আগস্ট) থেকে পুরো ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে পানির চাপে বাঁধ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছাড়ার ঘটনা দেখা গেছে। উজানে অমরপুর পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির (প্রটোকল) অংশ হিসেবে। এর আওতায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বন্যাসংক্রান্ত যেকোনো তাৎক্ষণিক তথ্য বাংলাদেশকে দিয়ে থাকে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ‘গত বুধবার বেলা ৩টা পর্যন্ত পানিপ্রবাহ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার তথ্য বাংলাদেশকে পাঠানো হয়েছে। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে বন্যার কারণে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটে। আমরা জরুরি তথ্য সরবরাহ নিশ্চিতে অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি।’
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার অভিন্ন নদীগুলোতে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি একটি যৌথ সমস্যা। এটা উভয় দেশের মানুষের জন্য দুর্ভোগের জন্ম দেয়। এ সমস্যার সমাধানে ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। এসব নদীর পানি নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দ্বিপক্ষীয় পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত আলোচনার মাধ্যমে পানিসম্পদ ও অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা–সংক্রান্ত বিদ্যমান সমস্যা ও পারস্পরিক উদ্বেগের সমাধান করতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এ ছাড়া গতকাল বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বন্যা হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পানি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ত্রিপুরার বন্যাকে ‘খুব নজিরবিহীন’ বর্ণনা করে হাইকমিশনার বলেন, এটি বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দিকেই বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। যার ফলে ত্রিপুরায় ৫০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন উপদেষ্টারা
দেশের সব বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর এ কথা বলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সকাল ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের এ বৈঠক হয়।
প্রধান উপদেষ্টার যমুনা কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বন্যা-দুর্গতদের দুর্দশা প্রশমনে সহায়তা করতে উপদেষ্টারা বন্যা-দুর্গত সব জেলা পরিদর্শন করবেন। বৈঠকে তারা দেশের বন্যা পরিস্থিতি, বন্যা-দুর্গতদের জন্য সরকার কী করতে পারে এবং কীভাবে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা যায়, বন্যার পেছনের কারণ কী এবং ভবিষ্যতে বন্যা মোকাবিলায় সরকার কী করতে পারে সেসব বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফেনির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন। তিনি মাঠ পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রমে সমন্বয় করবেন। ত্রাণ, পানি, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় করতে হবে। উজানে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সময়ে বন্যাকবলিত এলাকায়ও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে ভবিষ্যতে আগাম সতর্কতা কীভাবে পাওয়া যাবে, আমাদের আগাম সতর্ক করা হয়েছে কি না, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে জনগণকে সতর্ক করার মাধ্যমে জীবন ও সম্পদহানি রোধে রাষ্ট্রগুলো কীভাবে কাজ করতে পারে, নির্দিষ্ট কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে সে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যতক্ষণ না বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং তাদের পুনর্বাসন করা শেষ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত উপদেষ্টা পরিষদ বন্যার ওপর নজরদারি করবে।’
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে জানান, দেশের ১০টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে ৩৬ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সব উপদেষ্টাকে বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি উপদেষ্টাদেরকে বন্যাকবলিত মানুষের অবস্থা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিতে বলেছেন।