ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বাড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগ
প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৪ ২১:১৩ পিএম
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৪ ২১:১৪ পিএম
ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের বাড়িঘরে হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনা তদন্ত এবং এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যমে অসত্য সংবাদ প্রচার বন্ধের দাবি জানিয়েছেন দেশের ৩৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বুধবার (১৪ আগস্ট) রাতে সংবাদমাধ্যমে এই বিবৃতি পাঠানো হয়। এতে হামলায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিগত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকশ সংখ্যালঘু মানুষ বিশেষত হিন্দু নাগরিকদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মন্দিরে হামলা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি স্থানে দুষ্কৃতিকারীরা আদিবাসীদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। এ ছাড়া দুটি জেলায় সংখ্যালঘু আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপসনালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগ করেছে বলে আমরা জেনেছি। এ ছাড়া অন্যান্য এলাকা থেকে আক্রমণ-লুটপাট-অগ্নিসংযোগের যে তথ্য আমরা পেয়েছি তাতে দেখা যায়, সব হামলাই যে ধর্মীয় কারণে বা সম্পদ দখলের জন্য হয়েছে তা নয় বরং অনেক ক্ষেত্রেই হামলা হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষোভ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য।’
এতে বলা হয়, যশোরের বাঘারপাড়া এলাকায় অনেক পরিবারের তথ্য পাওয়া যায়, যারা সহিংস আক্রমনের শিকার হয়েছেন, তাদের কোন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই। খুলনায় কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্থাপনায় আক্রমণ হয়েছে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে এবং কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে শুধুমাত্র সংখ্যালঘু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে। এই জেলায় হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়াও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা সুন্নি সম্প্রদায় নয় বা আহম্মদীয়া সম্প্রদায়ের, তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। একই সাথে ময়মনসিংহের শশী লজের ঐতিহাসিরক ভাস্বর্য, দিনাজপুরে সিধু-কানুর ভাস্কর্য, হাইকোর্টে প্রাঙ্গণের ভাস্বর্য ভেঙ্গে ফেলার যে ঘটনা ঘটেছে তাকে নিতান্তই ধর্মান্ধ সহিংসতার অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে যে উদ্দেশ্যেই এই সব হামলা, লুটপাট বা অগ্নি সংযোগ বা ভাস্কর্য ভাঙ্গা হয়ে থাকুক না কেন, প্রতিটি সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী সব অপতৎপরতার আমরা নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমাদের সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন দাবি হচ্ছে, প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে এবং তদন্ত করে সহিংসতা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সাথে যুক্তদের শনাক্ত করে অবিলম্বে বিচার ও আইন অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অনেক এলাকায় মন্দির, গির্জা ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরের সুরক্ষায় এবং হামলা প্রতিরোধে অনেক জায়গায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসেছেন এ খবরও আমরা নিয়মিত পাচ্ছি। এই জনসম্পৃক্ততা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। একই সময় আমরা লক্ষ করছি, এই সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে অতিরঞ্জিত খবর, অসত্য তথ্য এবং গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে একটি মহল অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে, গত ৭ আগস্ট থেকে কয়েকদিন ভারতের এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হামলার শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয়ের জন্য সীমান্তে জড়ো হয়েছেন এবং বিএসএফ তাদের আটকে দিয়েছে বলে প্রচার করছে। অথচ ১২ আগস্ট ২০২৪ ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধার গোতামারী গ্রামে সীমান্তের শূন্যরেখায় সহস্রাধিক হিন্দুকে জড়ো করা হয়, তবে পরে এটা গুজব বুঝতে পেরে তারা নিজ নিজ এলাকায় নিরাপদে ফিরে গেছেন। এর আগে গত ৭ আগস্ট বুধবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী কাজলদীঘি কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের লাহিড়ীপাড়া এলাকায়।
এতে বলা হয়, কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা গত ১২ আগস্ট ময়মনসিংহ এবং তার পাশ্ববর্তী এলাকাগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে। ময়মনসিংহ শহরে আইনজীবী পীযুষ কান্তি সরকারের চেম্বার পোড়ানো হয়েছে, তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। স্থানীয়দের মতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ক্ষোভের কারণেই তার চেম্বারে আগুন দেয়া হয়েছে। তার চেম্বারের সাথেই একজন মুসলিম আইনজীবীর চেম্বারও পোড়ানো হয়েছে। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে শ্যামল কান্তি পালের দোকান ভাঙ্গার খবরের তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, তিনি আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আর দোকান খোলেননি। দোকানটিতে কোন ভাঙচুরের চিহ্ন নেই। পাশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি সোনার দোকানসহ দুইটি দোকান খোলা রয়েছে। শ্যামলের ছোট ভাই তাপস কান্তি পালও নিয়মিত এ বাজারে আসা যাওয়া করছেন। নেত্রকোণার রামকৃষ্ণ মিশনে ভাঙচুরের কথা শোনা গেলেও মিশনের সেক্রেটারি জানান পাশে একটি আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙচুর হলেও তাদের মিশনের কোন ক্ষতি বা ভাঙচুর হয়নি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য মতে ২৯টি জেলায় এই সংখ্যালঘু হামলার ঘটনা ঘটেছে।
সামাজিকমাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচার থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা প্রত্যেককে অনুরোধ করছি, এর পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশ ভারতের গণমাধ্যমের একাংশে এখানকার সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনাকে নিয়ে অতিরঞ্জিত, বিকৃত ও অসত্য খবর প্রচারের চেষ্টা বিষয়টি বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রনোদিত। আমরা আরও বেশি উদ্বিগ্ন এজন্য যে, এই অপপ্রচারের পেছনে ভারতের ক্ষমতাসীনদের সাথে জড়িত স্বার্থান্বেষী কুচক্রিমহল সক্রিয় থাকতে পারে। আমরা মনে করি এতে করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর, অসত্য ও বিকৃত তথ্য প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সংবাদ মাধ্যমের কর্তৃপক্ষের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। ভারতের সাথে ঐতিহাসিক সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখা ও জোরদার করার স্বার্থেই এটা তাদের করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেছেন
* সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
* খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি
* আনু মোহম্মদ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
* ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
* রাশেদা কে চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, গন-স্বাক্ষরতা অভিযান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
* শিরিন হক, সদস্য, নারীপক্ষ
* এড. সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
* মনিন্দ্র কুমার নাথ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
* জেড. আইন খান পান্না, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
* গীতি আরা নাসরিন, অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*ড. পারভীন হাসান, ভাইস চ্যান্সেলর, সেন্টাল উইম্যান ইউনিভার্সিটি
*ড. ফস্টিনা পেরেইরা, মানবাধিকার আইনজীবী
*ড. নাঈমা হক, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*ড. তানজিমউদ্দিন খান, অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*ডা. নায়লা জে. খান, ডিরেক্টর, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন
*ড. সুমাইয়া খায়ের, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়
*শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি
*এড. সালমা আলি, নির্বাহী পরিচালক, বিএনডব্লিউিএলএ
*ড. স্বপন আদনান, ভিজিটিং প্রফেসর, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়
*এড. সাইদুর রহমান, প্রধান নির্বাহী, এমএসএফ
*এড. মিনহাজুল হক চৌধুরী, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
*নাসের বখতিয়ার, সিনিয়র ব্যাংকার
*তাসনীম সিরাজ মাহবুব, সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*ফিরদৌস আজিম, অধ্যাপক, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়
*ফারহা তানজীম তিতিল, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
*ড. শহিদুল আলম, আলোকচিত্রী
*রাহনুমা আহমেদ, কবি ও লেখক
*সাঈদা গুলরুখ, সাংবাদিক
*রোজিনা বেগম, মাহিডন বিশ্ববিদ্যালয় , থাইল্যান্ড
*নাসরিন খন্দাকার, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
*আকমল হোসেন, প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক কোস্ট ট্রাস্ট
*রুশাদ ফরিদী, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*সাদাফ নূর, গবেষক, ল্যাংকেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়
*ড. নোভা আহমেদ, শিক্ষক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
*দীপায়ন খীসা, কেন্দ্রিয় সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
*হানা শামস আহমেদ, আদিবাসী অধিকার কর্মী