বাছির জামাল
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪ ০৯:২২ এএম
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় স্থবির সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা। গত ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দিন থেকে আকাশপথ বাদে সড়ক, নৌ ও রেলপথে ঢাকার সঙ্গে আন্তঃজেলার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন হাজার হাজার যাত্রী। কারফিউ শিথিল হওয়ায় গত ২৪ জুলাই থেকে ঢাকার সঙ্গে আন্তঃজেলার যোগাযোগ সীমিত পরিসরে শুরু হলেও এতে ভরসা কেবল বাস। অবশ্য স্বল্পসংখ্যক লঞ্চ চলাচলও করছে অল্প কিছু রুটে। কারফিউ শিথিলের সময়ের ওপর নির্ভর করেই শুধু এই বাস-লঞ্চ চলাচল করছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তাও বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। আকাশপথে যাতায়াতে বাধা না থাকলেও এক্ষেত্রে সবার সামর্থ্য সীমিত। ফলে যোগাযোগে জনগণের ভোগান্তি থেকেই গেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে সারা দেশের উদ্দেশে বাস চলাচল শুরু হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। বাস চলছে শুধু কারফিউ শিথিলের সময়ে। এই সময় চলে গেলে বিপদে পড়তে হয়।’
রাজধানীর কমলাপুর স্টেডিয়ামের পাশে অবস্থিত ইউনিক বাস পরিবহনের কাউন্টারের ম্যানেজার সোহেল জানান, ২৪ জুলাই থেকে সীমিত পরিসরে আমাদের বাসসার্ভিস শুরু হয়েছে। যাত্রী হলে আমরা বাস ছাড়ছি। তবে আগের তুলনায় ট্রিপের সংখ্যা কম।
তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন বাসমালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্যাহ ভিন্নমত দেন। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে সারা দেশেই বাস চলছে। কোনো বাধা নেই।’
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলনের মধ্যে ১৮ জুলাই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দিন সারা দেশে ট্রেনসহ বাস ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন বিকাল থেকে ঢাকায় সরকারি নানা স্থাপনায় নজিরবিহীন হামলা শুরু হয়, ভেঙে দেওয়া হয় রাজধানীর মেট্রো রেলের দুটি স্টেশন। পরের দিন সহিংসতা আরও বেড়ে যায়, শুক্রবার ১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ ঘোষণা করে সরকার।
পরদিন ২০ ও ২১ জুলাই দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হলেও গণপরিবহন চলেনি বললেই চলে। বুধ ও বৃহস্পতি কারফিউ শিথিলের মেয়াদ সকাল ১০টা থেকে বাড়িয়ে বিকাল ৫টা করা হয়। গতকাল শুক্রবার ও আজ শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়। শিথিলের মেয়াদ বাড়ানোর পর রাজধানীতে গণপরিবহন বেড়েছে, সড়কে যানজটও দেখা গেছে। রাজধানীতে ২০ জুলাই সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে মেট্রোরেল চলাচল।
ট্রেন আপাতত চলবে না
গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, ময়মনসিংহ ও রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় রেলপথ অবরোধ করা হয়। তাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। পরের দিন ট্রেন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে ১৮ জুলাই থেকে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন ঢাকার মহাখালীতে রেললাইনে আগুন ধরিয়ে অবরোধ করা হয়। ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন জায়গাতেও একই ঘটনা ঘটে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া ট্রেন সেবা গত বৃহস্পতিবার থেকে সীমিত পরিসরে চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল গত বুধবার। এদিন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব হুমায়ুন কবির বলেছিলেন, ‘প্রাথমিকভাবে কারফিউ শিথিল থাকার সময়ে ঢাকা থেকে কাছাকাছি দূরত্বে কমিউটার ট্রেন চলবে। আন্তঃনগর ট্রেনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে পরে।’ তবে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে রেল কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইফতেকার আলম রাজন জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ট্রেন চলবে। বৃহস্পতিবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ডিজিসহ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বৈঠকে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সারা দেশের খবর
কারফিউ শিথিলের সময় থেকে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগের ভরসা এখন বাস। সীমিত পরিসরে হলেও দিন-রাতে সড়কপথে সারা দেশে বাস চলাচল করছে।
প্রতিদিনের বাংলাদেশের খুলনা অফিস জানায়, খুলনায় দিনের বেলায় কারফিউ শিথিল করায় সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে খুলনা থেকে রাজধানী ঢাকা, রাজশাহীসহ উত্তরবঙ্গ এবং কলকাতার সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আব্দুল গফফার বিশ্বাস জানান, সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকায় খুলনা থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যে দিনের বেলায় যাতায়াতকারী পরিবহনগুলো সঠিকভাবে চলছে। তবে রাতের বেলায় কারফিউ থাকায় রাতের পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী নিরাপত্তা দিলে ক্রমান্বয়ে রাতের পরিবহনও চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে বাসমালিক সমিতির।
খুলনা বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাকির হোসেন বিপ্লব জানান, কারফিউ শিথিলের সঙ্গে সঙ্গে খুলনা থেকে বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, পিরোজপুর, বরিশাল ও মোংলাসহ ১৮টি রুটে যাত্রীবাহী বাস চলাচল শুরু করেছে। ঢাকাসহ দূরপাল্লার যানবাহনও চলেছে সময়মতো। বিশেষ করে দিনের বেলা কারফিউমুক্ত থাকায় আন্তঃজেলা বাস ও রাজধানীগামী পরিবহন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। সন্ধ্যার পর কারফিউ বহাল থাকায় কোনো বাস ও পরিবহন চলাচল করছে না।
খুলনা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার জয়ব্রত সাহা জানান, খুলনা থেকে ঢাকা, রাজশাহী, ঈশ্বরদী, গোয়ালন্দ, বেনাপোল, মোংলা, পার্বতীপুর, দিনাজপুরগামী সকল লোকাল ও আন্তঃনগর ট্রেন এবং কলকাতাগামী বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনও বন্ধ রয়েছে। অফিসিয়াল কোনো নির্দেশনা না আসায় খুলনা থেকে সব রুটের ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
বরিশাল অফিস জানায়, বরিশাল জেলা বাসমালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে জানান, সকাল ৬টা থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লা রুটের বাস চলাচল শুরু হয়েছে। কারফিউ শিথিল সময়ের মধ্যে গন্তব্যস্থানে পৌঁছতে পারবেÑ সেভাবে সময় হিসাব করে বাস চলাচল করছে।
বরিশাল নৌবন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক জানান, অভ্যন্তরীণ রুটের লঞ্চ চলছে। তবে ঢাকা বরিশাল রুটের লঞ্চ বন্ধ রয়েছে।
রাজশাহী অফিস জানায়, রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ-সভাপতি মতিউল হক টিটো বলেন, কারফিউ শিথিলের সময়ের ওপর নির্ভর করে বাস চলাচল করছে। শুক্রবার মাত্র তিন ঘণ্টা কারফিউ শিথিল ছিল। এ কারণে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ ছিল। আগামীকাল ৯টা-৫টা কারফিউ শিথিল থাকবে, তখন আমরা বাস ছাড়ব।
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকায় দূরপাল্লার যাত্রায় চট্টগ্রামের যাত্রীদের বাসের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে মহানগরীর দামপাড়া এলাকার বেশ কয়েকটি বাস কাউন্টার ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রীদের খুব বেশি চাপ নেই। স্বাভাবিক সময়ের মতোই লোকসমাগম দেখা গেছে কাউন্টারগুলোতে। সৌদিয়ার এক্সিকিউটিভ মনজুর মোর্শেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের বাসগুলো আগের মতোই নিয়মমাফিক ছেড়ে যাচ্ছে। যাত্রীর পরিমাণও আগের মতো আছে।’ পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন রেল বন্ধ থাকার পরও বাসে যাত্রীদের বাড়তি চাপ না থাকায় এটা বোঝা যাচ্ছে যে, মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া দূরপাল্লায় যাত্রা করছে না।
সিলেট অফিস জানায়, সিলেটে সীমিত পরিসরে দূরপাল্লার বাস চলাচল করছে। সময়সূচি ছাড়াই সিলেট থেকে রাজধানীসহ সিলেট বিভাগের অন্য জেলাগুলোতে বাস ছেড়ে যাচ্ছে। তবে পরিবহন নেতারা জানিয়েছেন, দিনের বেলা জরুরি অবস্থা শিথিল হলেও যাত্রীর সংকট থাকায় নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়তে পারছেন না অনেকে। যাত্রীর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে বাসচালকদের।
এ ব্যাপারে বাস, মিনিবাস, কোচ ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সিলেট বিভাগীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর রাজন বলেন, কারফিউর কারণে আতঙ্কে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। যার কারণে বাসে যাত্রী সংকট রয়েছে। যেখানে ২০-৩০ মিনিট পরপর বাস ছাড়া হতো, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। বাসের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিক, হেলপার ও সুপারভাইজার ৩ হাজার করে মোট ৯ হাজার লোক বেকার অবস্থায় আছে। বাস টার্মিনালে বসে অলস সময় পার করছেন তারা।
রংপুর অফিস জানায়, রংপুর জেলা মোটর মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফতাবুজ্জামান লিপন জানান, ‘কারফিউ শিথিলসময়ে বাস চলাচল করছে। তবে যাত্রী কম।’
লঞ্চের পরিস্থিতি
বাংলাদশে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) জানিয়েছে, কারফিউ শিথিল সময়ের মধ্যে ঢাকা নদীবন্দরসহ অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর ও লঞ্চঘাটসমূহ হতে বিভিন্ন রুটে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে টানা ৫ দিন বন্ধ থাকার গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের রুটগুলোতে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়। তবে টার্মিনাল এলাকায় এখনও যাত্রীদের তেমন উপস্থিতি নেই।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সদরঘাট নৌ-টার্মিনাল ও পন্টুন এলাকা ঘুরে গেছে, পন্টুনে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, নোয়াখালী রুটের এক ডজনের বেশি লঞ্চ। চাঁদপুরের লঞ্চগুলোতে যাত্রী উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো হলেও অন্য রুটের লঞ্চগুলোতে যাত্রী উপস্থিতি একেবারেই হাতে গোনা।
ঘাট ও লঞ্চসংশ্লিষ্টরা জানান, কারফিউ শিথিল সময়ে সকাল ১০টা থেকে লঞ্চ চলাচল করছে সদরঘাট থেকে। বিকাল ৫টা পর্যন্ত ছেড়ে যাবে লঞ্চগুলো। বৃহস্পতিবার ২টি লঞ্চ ভোলা, চাঁদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ১২টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে ও ৮টি লঞ্চ বিভিন্ন স্থান থেকে ছেড়ে এসে ঘাটে ভিড়েছে।
সদরঘাট নৌ-টার্মিনালের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর একেএম বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত ৮টা লঞ্চ আগমন এবং ১২টা লঞ্চ নির্গমন করেছে। তবে যাত্রীর চাপ নেই ঘাটে।’