× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

এনবিআরের মতিউর কীভাবে এত সম্পদের মালিক!

আলাউদ্দিন আরিফ

প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪ ২৩:২৯ পিএম

এনবিআরের মতিউর কীভাবে এত সম্পদের মালিক!

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বহুল আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনে ভাইরাল হওয়া ‍১৯ বছর বয়সি তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাতের বাবার সম্পদ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রে ১৫ লাখ টাকার ছাগল ও ছাগল ক্রেতার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমান। যদিও মতিউর ইফাতকে তার ছেলে হিসেবে অস্বীকার করেছেন। তিনি বর্তমানে কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি এই কর্মকর্তা দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ইতোমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে তার বেশুমার সম্পদের তথ্য। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মতিউরের জ্ঞাত এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য জানতে মাঠে নেমেছে। আর প্রাক অনুসন্ধানে তারা পেয়েছে বিস্ময়কর সব তথ্য। 

বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের আলহাজ আব্দুল হাকিম হাওলাদারের ছেলে মতিউর রহমান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স করার পর এমবিএ করেন। শুরুতে ১৯৯০ সালে চাকরি নেন পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনে। পরে ১৯৯৩ সালে ১১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ‘কাস্টমস ক্যাডার’ হিসেবে যোগ দেন এবং ২০১৫ সালে কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পান। মতিউর রহমান ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনারসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের (সিইভিটি) প্রেসিডেন্ট। তার বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু করেনি দুদক। তবে প্রাক অনুসন্ধানের জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু হয়েছে। গোয়েন্দাদের হাতে বেশ কিছু সম্পদের তথ্যও জমা হয়েছে। সেগুলোর প্রকৃত মালিক মতিউর রহমান কি না সেটা এখন যাচাই বাছাই চলছে। 

জানতে চাইলে দুদকের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মতিউর রহমানের নামে থাকা সম্পদের কিছু ফিরিস্তি আমরা পেয়েছি। ঈদের বন্ধ থাকায় সেগুলোর প্রকৃত মালিকানা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।’ তার নামে যেসব সম্পদ থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজধানীর ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের ৭/এ সড়কের ৩৮৪ নম্বর বাড়িতে স্ত্রীর নামে ৫০১ নম্বর ফ্ল্যাট, একই ব্লকের ১ নম্বর সড়কের ৫১৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৭ তলা বাড়ি; আনুমানিক দাম ৪০ কোটি টাকা। এই বাড়ির দোতলাতেই পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মতিউর রহমান। 

ময়মনসিংহের ভালুকা থানার সিডস্টোর এলাকার পাশেই প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ওপর গ্লোবাল জুতার ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরির চেয়ারম্যান মতিউর রহমান নিজেই। এই ফ্যাক্টরিতে দেশি-বিদেশি প্রায় ৪০০ শ্রমিক কাজ করেন। এই কারখানায় উৎপাদিত জুতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। 

অভিযোগ রয়েছে, ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মতিউর রহমান, তার স্ত্রী, পরিবারের সদস্য ও বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের নামে রয়েছে ৪০টি প্লট। নরসিংদীর বেলাবতে ৪০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে তার বিলাসবহুল রিসোর্ট। রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে শাহবুদ্দিন পার্কের উল্টোদিকে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের একটি ভবনে চারটি ফ্ল্যাটও আছে তার নামে-বেনামে। যার প্রতিটার দাম প্রায় ৫ কোটি টাকা করে। গুলশানের শান্তা প্রোপার্টিজের একাধিক প্রজেক্টে আছে ৮টি ফ্ল্যাট। গোয়েন্দা তথ্যমতে, মতিউরের একটি ব্যাংক হিসাবে জমা আছে ১১৭ কোটি টাকা। 

মতিউর রহমানের জেসিএক্স নামে একটি যৌথ মালিকানাধীন ডেভেলপার কোম্পানিও রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের নতুন প্রজেক্ট বসুন্ধরার আই ব্লকের সুবহান অ্যাভিনিউয়ের ৬৫৭ এ ও ৬৫৭ বি নম্বর প্লটে। ৭১৬ নম্বর রোডে ৯-১০ নম্বর প্লটে ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবনেরও কাজ চলছে। 

এ ছাড়া গাজীপুর সদর, রাজধানীর খিলগাঁও মৌজায় বিভিন্ন দাগে ৪৭ শতাংশ জমি, সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ৮টি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে এই রাজস্ব কর্মকর্তার। যার বর্তমান দাম প্রায় ৪০ কোটি টাকা। 

মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১৪ শতাংশ, গাজীপুর সদরের ৪৮ দশমিক ১৬ শতাংশ ও অন্য দাগে ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ জমি রয়েছে। গাজীপুরে ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে আরও ৪৫ শতাংশ জমির খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া গ্লোবাল সুজ লিমিটেড নামে গাজীপুরেও রয়েছে ৭ খতিয়ানে ৬০ শতাংশ জমি। যার মূল্য প্রায় ৯০ কোটি টাকা।

রাজধানীর পুবাইলের খিলগাঁও মৌজায় ৪০ বিঘা জমিতে ‘আপন ভুবন পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পট’ নামে একটি রিসোর্ট করেছেন মতিউর রহমান ও তার স্ত্রী লায়লা কানিজ। পুবাইলের খিলগাঁও মৌজায় আরও প্রায় ৬০ বিঘা জমি আছে তাদের এমনটাই দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। 

মতিউর পরিবারের সদস্যদের রয়েছে অনেকগুলো বিলাসবহুল গাড়ি। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই এবং যুক্তরাষ্ট্রেও বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক মতিউর পরিবারের সদস্যরা। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, মতিউর রহমানের বড় গুণ হলো সুন্দর কথা বলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মন জয় করা। বিশ্বস্ত বাহিনী দিয়ে কর ফাঁকি দেওয়া ব্যাবসায়ীদের খুঁজে বের করেন তিনি। রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরাই তার মূল টার্গেট ছিল। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তার জন্য চুক্তি করতেন মতিউর। পরে চুক্তি অনুযায়ী অর্থ নিয়ে কিছু অংশ তার দুর্নীতির সহযোগীদের এবং বড় অংশ নিজে নিয়ে নিতেন।

১ কোটি বিনিয়োগে ১৪ কোটি টাকা লাভের গল্প 

সংশ্লিস্ট একাধিক সূত্র জানায়, মতিউর রহমান নিজেকে পুঁজিবাজারের একজন ‘দক্ষ বিনিয়োগকারী’ হিসেবে দাবি করেন। শুধু মেয়ের নামে বিনিয়োগ করে ১ কোটি টাকায় তিনি ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন বলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি জানান, ট্যানারি খাতের কোম্পানি ফরচুন সু’র মালিকরা তার কাছের মানুষ। তাকে ওই কোম্পানির মালিকরা ৮ টাকা দামে শেয়ার দিয়েছিল। পরে তিনি ৫৪ টাকা দামে ওই শেয়ার বিক্রি করে অনেক মুনাফা করেন। মতিউর আরও দাবি করেন, তিনি একটি জমি বিক্রি করে সাড়ে ৪ কোটি টাকা পেয়েছিলেন। ওই টাকা থেকে পুঁজিবাজারে ২ কোটি টাকা নিজের নামে এবং ১ কোটি টাকা তার মেয়ে ফারহানা রহমানের নামে বিনিয়োগ করেন। শুধু তার মেয়ের বিনিয়োগ থেকেই তিনি ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন।

আলোচিত মতিউর এ সময়ে একটি হিসাবে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ১৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছেন। অর্থাৎ মুনাফার হার ১৪০০ শতাংশ। তার নিজের নামের বিনিয়োগ থেকে কত টাকা মুনাফা করেছেন তা না জানালেও সেটি ২০/২৫ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা যায়। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে চলছে মন্দা অবস্থা। এই বাজারে সিংহভাগ বিনিয়োগকারী বিপুল লোকসানের শিকার হলেও মতিউরের এই অবিশ্বাস্য মুনাফা অর্জনের বিষয়টি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কোনো ধরনের কারসাজি ছাড়া স্বাভাবিক বিনিয়োগ থেকে এমন মুনাফা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, যাদের রয়েছে দক্ষ ও পেশাদার রিসার্চ টিম, সেসব প্রতিষ্ঠানও এই সময়ে গড়ে ২০ শতাংশ মুনাফা করতে পারেনি।

ফোন রিসিভ করেননি মতিউর 

অভিযোগের ব্যাপারে কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমানের বক্তব্য জানতে দুটি নম্বরে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার ছবিযুক্ত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বক্তব্য চেয়ে মেসেজও দেওয়া হয়। তবে তিনি জবাব দেননি। 

জবাব দেননি এনবিআর চেয়ারম্যান

‘ছাগলকাণ্ড’ নিয়ে হইচই ফেলে দেওয়া তরুণ ও তার রাজস্ব কর্মকর্তা ‘বাবাকে’ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে। তবে তিনি এ ব্যাপারে কোনো জবাব দেননি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে টিসিবি ভবনে এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকরা এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চান, ফেসবুকে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনার পোস্ট দেওয়া তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাতের বাবা এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের অর্থের উৎস কী? তখন এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘এ নিয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না।’


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা