× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পুলিশও অসহায়, বজলুর ভয়ে মুখ খোলে না কেউ

প্রবা প্রতিবেদন

প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২২ ১৬:৫২ পিএম

আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২২ ১৬:৫৬ পিএম

পুলিশও অসহায়, বজলুর ভয়ে মুখ খোলে না কেউ

বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশের মৃত্যু ঘিরে ফের আলোচনায় চনপাড়া বস্তি। রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত প্রায় বিচ্ছিন্ন এই গ্রামটি মাদক কারবারি ও অপরাধীদের ‘অভয়াশ্রম’ হয়ে উঠেছে-এমন খবর এখন সবার মুখে মুখে।

যদিও চনপাড়ার ভয়াবহ চিত্র এর আগেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া এবং ভৌগোলিকভাবে কিছুটা দুর্গম হওয়ায় চনপাড়া বস্তি থেকে অপরাধীদের সাম্রাজ্য উৎখাত করা যায়নি, বরং দিনে দিনে তাদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। 

চনপাড়া বস্তিকেন্দ্রিক সকল অপতৎপরতার হোতা হিসেবে ঘুরেফিরে চলে আসে যার নাম; তিনি বজলুর রহমান ওরফে বজলু মেম্বার। চনপাড়া বস্তির মাদক কারবার, চাঁদাবাজিসহ সকল অপরাধের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। অপরাধের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন বজলু। তিনি একাধারে রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (চনপাড়া) সদস্য এবং ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান। স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে গত কয়েক বছরে আরও বেপরোয়া এবং ক্ষমতাবান হয়েছেন বজলু। তার ক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নৈরাজ্যও বেড়েছে চনপাড়ায়। 

গত রবিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চনপাড়া গ্রামে ঘুরে স্থানীয়দের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। যদিও বজলুর ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস নেই কারও। অনেক চেষ্টার পর স্থানীয় যে দুয়েকজন বাসিন্দা বজলু ও চনপাড়ার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন, তারাও নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চান না। 

ফারদিনের মৃত্যুর পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে চনপাড়ার চিহ্নিত মাদক কারবারি শাহীন মিয়া ওরফে সিটি শাহীন নিহত হওয়ার পর এলাকার পরিস্থিতি অনেকটাই থমথমে। স্থানীয় বাসিন্দাদের চলাফেরা দেখলেই বোঝা যায় সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশ আতঙ্কের মধ্যেই রয়েছেন তারা।

পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে এই প্রতিবেদকের কথা হয় স্থানীয় এক নারীর সঙ্গে। নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, একসময় চনপাড়ায় সামাজিক পরিবেশ ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রাখতে একজন জনপ্রতিনিধি বজলুদের মতো লোকজনকে মদদ দেওয়া শুরু করার পর চনপাড়ার পরিস্থিতি বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছর ধরে চনপাড়ায় অলিগলিতে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হয়। অবৈধ অস্ত্রের বিকিকিনিও চলে এই এলাকায়। মাদক কারবারি ও সেবনকারীদের কারণে এলাকার নারীরা স্বস্তিতে রাস্তাঘাটে চলাচল করতে পারেন না। কিশোরী ও তরুণীদের নিয়ে আতঙ্কে থাকেন তাদের অভিভাবকেরা। রাত যত গভীর হয়, চনপাড়ার চিত্র আরও ‘নারকীয়’ হয়ে ওঠে দাবি করে ওই নারী বলেন, সন্ধ্যার পর এই এলাকায় মাদকের হাট বসে। রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মাদকসেবী ও কারবারি এসে ভিড় করে চনপাড়ায়। বিক্রির পাশাপাশি চলে মাদক সেবনের মোচ্ছব। এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে খুন করে লাশ ফেলে দেওয়া হয় নদীতে। 

মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিত্যদিনই এই এলাকায় হানাহানি লেগে থাকে বলে জানালেন চনপাড়াসংলগ্ন এলাকার এক দোকানি। এ নিয়ে গত কয়েক বছরে একাধিক খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে বলেও জানা গেল তার কাছে। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় বসবাসকারী এই দোকানি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, মূলত বজলু জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর তার দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে। অস্ত্রবাজি করে ভোটে জিতে চাঁদাবাজি, জমি দখল, মাদক ও অস্ত্রের কারবারসহ সকল অপকর্মের রাজত্ব গড়েছেন তিনি চনপাড়ায়। তার কারণে এলাকার বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারেন না। পুলিশের কাছে অভিযোগ দিয়েও লাভ হয় না। 

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন বারবার উদ্যোগ নিয়েও ক্ষমতাবান একজন জনপ্রতিনিধির বাধার কারণে বজলুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। তবে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রভাবশালীর ছত্রছায়ার পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও চনপাড়ার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রশাসন খুব বেশি কিছু করতে পারছে না। চনপাড়া বস্তির তিনদিকে পানি, প্রবেশের পথ মাত্র একটি। তাই অভিযান চালাতে গেলে বিভিন্ন পথে অপরাধীরা পালিয়ে যায়। তা ছাড়া নদীতে ও সড়কপথে চনপাড়ার চারপাশে রীতিমতো পাহাড়া বসিয়ে রাখে মাদক কারবারিরা। তাই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনী সেখানে অভিযান চালাতে গেলে আগেভাগেই অপরাধীদের কাছে খবর পৌঁছে যায়। আবার বস্তিতেও অপরাধীদের ব্যাপক আধিপত্য রয়েছে। তাদের ধরতে গেলে বস্তির লোকজন পুলিশের কাজে বাধা দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

গতকাল চনপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বস্তির দুইপাশে শীতলক্ষ্য নদী, একপাশে বালু নদ। রাজধানীর ডেমরা এবং নারায়ণগঞ্জের নোয়াপাড়া ও মুড়াপাড়া থেকে নদীপথে চনপাড়ায় ঢোকা যায়। প্রবেশের তিন পথে রয়েছে তিনটি খেয়াঘাট। সড়কপথে চনপাড়ায় ঢোকার একমাত্র উপায় ডেমরা থেকে বালু সেতু। সেতু পার হলেই চনপাড়া মোড়। কায়েতপপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডটিই চনপাড়া। অসংখ্য অলিগলি থাকায় বাইরের লোকজনের কাছে চনপাড়া যেন এক গোলকধাঁধা। 

দেশের নদীভাঙনকবলিত বিভিন্ন এলাকায় ভূমিহীন মানুষের জন্য ১৯৭৪ সালে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে ওয়াসার ১২৬ একর জমিতে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দ্বীপের মতো ওই এলাকায় সময়ের পরিক্রমায় বসতি বাড়তে থাকে। শুরুতে সেখানকার বাসিন্দা ছিল সাড়ে ৫ হাজার। এখন বাসিন্দা লক্ষাধিক।

চনপাড়ার বাসিন্দারা জানান, শুরুতে এখানে বসতি গড়ে তোলা হতদরিদ্র ভাসমান মানুষজনের ওপর সহজে প্রভাব খাটিয়ে খামখেয়ালীর ঘাঁটি গড়ে তোলেন বজলুর মতো লোকজন। মাদক, অস্ত্র ও দেহব্যবসার জমজমাট হাট বানিয়ে এই এলাকা থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন বজলু ও তার দোসরেরা। একসময়ের ছিচকে সন্ত্রাসী থেকে বজলু এখন বিরাট ডন। চলাফেরা করেন অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে। বজলুর ছত্রছায়ায় চিহ্নিত ও দাগী অপরাধীরা তাদের গা ঢাকা দেওয়ার এলাকা হিসেবেও ব্যবহার করছে চনপাড়াকে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, বস্তিতে মাদকের বেশিরভাগ চালান ঢোকে নদীপথে। মাদক সিন্ডিকেটে রয়েছেন একাধিক নারী সদস্য। তারাও বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক বহন করে বস্তিতে নিয়ে আসেন। মাদকের স্পট নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে রয়েছেন জয়নাল আবেদীন, শমসের, রোকসানা, মোস্তফা, রায়হান, ফালান, রাজু আহম্মেদ ওরফে রাজা, শাহাবউদ্দিন, শাওন, আনোয়ার, স্বপন, রহিমন, নাসির, শাহীন, আসাদুল, শাহ্ আলম, শাহিদা, বিল্লাল, রওশানাসহ অনেকে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত সিটি শাহীন ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। এই কারবারিরা সবাই বজলু মেম্বারের লোক হিসেবে পরিচিত।

চনপাড়া থেকে বের হওয়ার সময় কথা হয় একজন অটোরিকশাচালকের সঙ্গে। তিনিও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিটি শাহীনের মৃত্যুর পর এলাকার মানুষ ভীষণ আনন্দিত। কারণ শাহীনের কারণে এলাকার ছেলেপেলেরা সবাই মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছিল। মাদক সেবনের পর শাহীনের জোরজবরদস্তির শিকার হয়েছেন অনেকে। তার কারণে এলাকার অনেক তরুণী অন্ধকার পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বজলু এবং বড় রাজনীতিকদের ছায়ায় থাকায় এতদিন শাহীনের কিছু হয়নি। কিন্তু বজলুর ভয়ে শাহীনের মৃত্যু নিয়ে চনপাড়ায় প্রকাশ্যে কোনো আলোচনা নেই। ঘটনার পর থেকে মাদক কারবারিরা কিছুটা আড়ালে চলে গেলেও মাদকের কারবার থেমে নেই। 

বজলুকে নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে এমন আতঙ্কের অন্যতম কারণ গত এক দশকে ঘটে যাওয়া একাধিক হত্যাকাণ্ড। চনপাড়া বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই সময়ে নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা চান মিয়া, ইউপি সদস্য বিউটি আক্তার কুট্টি ও তার স্বামী হাসান মুহুরী, ফিরোজ সরকার, ফারুক মিয়া, পুলিশের এএসআই হানিফ মিয়া, ফালান মিয়া, আব্দুর রহমান, র‌্যাব সোর্স খোরশেদ মিয়া, প্রজন্ম লীগ নেতা মনির হোসেন, আসলাম হোসেন, যুবলীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সজল, সামসুর মতো অনেকে। প্রায় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডেই কোনো না কোনাভাবে নাম এসেছে বজলুর। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলাও রয়েছে রূপগঞ্জ থানায়। তবু আইনের ফাঁক গলে বহালতবিয়তে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। 

চনপাড়ার পরিস্থিতি জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, চানপাড়া এলাকার মাদক কারবারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে বুয়েটছাত্র ফারদিনের মৃত্যুর পর পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একাধিক সংস্থাও মাঠে নেমেছে। চনপাড়া ও আশপাশের এলাকায় টহল বাড়ানো হয়েছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা