সাফি উল্লাহ্
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২৩:২৮ পিএম
ভাষা হলো নদীর প্রবাহের মতো। এতে স্রোত থাকে, বাঁকবদল ও পরিবর্তন থাকে। ভাষার যেমন স্রোত থাকে, তেমনি ইতিহাসের স্রোতে, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্রোতেও কখনও কখনও ভাষা গা ভাসায়, তখন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক নানা অনুষঙ্গ ও ঘটনা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। রাজাকার শব্দের আভিধানিক অর্থ স্বেচ্ছাসেবক হলেও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের যেসব দোসর পাকিস্তানি শোষকের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেছে, তাদের বোঝায়। অর্থাৎ তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধী। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মতো ঐতিহাসিক ঘটনায় রাজাকার শব্দের প্রায়োগিক অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে। এখন স্বেচ্ছাসেবক বোঝাতে বাংলাদেশে কেউ রাজাকার শব্দটি আর ব্যবহার করে না। এভাবে ইতিহাসের স্রোতে ভাষা নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। একইভাবে বিভিন্ন সময় নানা ঘটনা, প্রতিবাদ, গান, উক্তি ইত্যাদি মুহূর্তেই সবখানে ছড়িয়ে পড়ে, সেখান থেকে কিছু শব্দ লোকমুখে চলে আসে, ভাষার মূলস্রোতে যুক্ত হয় এবং ভিন্নতর অর্থ সৃষ্টি করে।
বাংলা ভাষার জন্ম অনেক আগে হলেও এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেতে বাংলাভাষী মানুষদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করতে হয়েছে। শোষকশ্রেণি তাদের উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। বাংলাপ্রেমী ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ করেছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, রক্ত দিয়েছে। সে ভাষা আন্দোলনের পর একাত্তরটি বছর পেরিয়ে গেছে। বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে চেতনাকে ধারণ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে বীর বাঙালি জীবন দিয়েছে, তাকে একুশের চেতনা বলে অভিহিত করি। অমর একুশ মানেই ভাষা-প্রেম, অমর একুশ মানেই ভাষার জন্য জীবন বাজি রাখা। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো- ভাষা কি চিরদিন এক রকম থাকে? একাত্তর বছরে ভাষার প্রবাহে পরিবর্তন আসেনি? উত্তরে প্রথমত বলব- বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয়করণের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষ সংগ্রাম করেছেন। দ্বিতীয়ত বলব- ভাষা কখনও স্থির থাকে না, পরিবর্তনই ভাষার ধর্ম। বাংলা ভাষা-প্রবাহেও পরিবর্তন এসেছে। বাংলা ভাষার এ পরিবর্তন বায়ান্নর সংগ্রামের আগেও হয়েছে, এমনকি এখনও সে প্রক্রিয়া চলমান।
ভাষার বৈশিষ্ট্য হলো পরিবর্তিত হওয়া, অন্য ভাষার শব্দ প্রয়োজনে নিজের করে নেওয়া, নিজের কিছু শব্দ পৃথিবীর শব্দভাণ্ডারে জমা দেওয়া ইত্যাদি। বাঙালির ইতিহাস অনেক পুরোনো, এখানে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কারণে ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজ, তুর্কিসহ অনেক ভাষাভাষী এসেছে, ব্যবসা করেছে। কেউ কেউ শাসন করেছে আর আমাদের দিয়ে গেছে তাদের কিছু শব্দ, তাদের খাবারের নানা পদ, তাদের সংস্কৃতি। শুধু দিয়ে গেছে এমন নয়, আমাদের সম্পদ-সংস্কৃতি নিয়েও গেছে। তারা যেহেতু ক্ষমতাবান ছিল, কেউ কেউ ছিল শাসকশ্রেণির, তাই আমাদের ওপর তাদের প্রভাবটা উল্লেখযোগ্য হওয়াই স্বাভাবিক। যাই হোক, বাংলা ভাষায় যেমন নিজস্ব শব্দসমুদ্র রয়েছে, তেমনি অন্য ভাষার শব্দও বাংলায় যুক্ত হয়েছে। তারা এমনভাবে আমাদের ভাষায় মিশে গেছে, আলাদা করে বের করা অনেকাংশেই মুশকিল। গোসল, মালিক, আইন, সরকার, অফিস, ইউনিয়ন, বালতি, রেস্তোরাঁ, পানি, লেবু ইত্যাদি বহুল ব্যবহৃত এই শব্দসমূহ বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলা হুবহু গ্রহণ করেছে। আবার হাসপাতালের মতো কিছু শব্দ সামান্য পাল্টে নিজের করে নিয়েছে। ভাষা এমনই, এভাবেই ভাষা টিকে থাকে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব, খবরের অনলাইন পোর্টাল, বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলসহ নানা কারণে মানুষের, বিশেষত তরুণদের ভাষায় ইংরেজি-মিশ্রণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কথার মাঝে মাঝে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলা যেন উন্নত আর্থসামাজিক অবস্থানকে প্রকাশ করে। প্রয়োজনার্থে ইংরেজি বা অন্য ভাষার শব্দ মেশানোয় তেমন দোষের কিছু নেই, তবে জোর করে অদরকারে অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করলে ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট হয়। বাংলায় প্রচলিত পরিভাষা থাকলে সেটা ব্যবহার করাই কাম্য। তবে যেসব ক্ষেত্রে অন্য ভাষার শব্দই পরিভাষায় পরিণত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আলাদা উপায় নেই। যেমন- কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, মাল্টিমিডিয়া ইত্যাদি। অন্য ভাষার শব্দের এই সাবলীল সংযোজন বাংলার স্রোতকে গতিশীল করেছে বলে আমার মনে হয়।
অন্য ভাষার শব্দের মিশ্রণ ছাড়াও বাংলা ভাষার নানা প্রকরণ রয়েছে- অঞ্চলভেদে বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ রয়েছে। প্রমিত রূপ রয়েছে- যে ভাষা আমরা দাপ্তরিক কাজকর্মে ব্যবহার করি। আবার মহানগর ও বড় বড় শহরে বিভিন্ন অঞ্চলের ও প্রমিত বাংলার শব্দ মিলে নতুন এক প্রকরণের সৃষ্টি হয়েছে। একজন বাঙালি কোথায় প্রমিত আর কোথায় আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করবে, কোন প্রেক্ষিতে কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করবে, কতটুকু অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার করবে, তার সমাধান ভাষার পরিমিত ব্যবহারের মধ্যেই নিহিত। একুশ শতকের তরুণ হিসেবে আমার মনে হয়- ভাষা পরিবর্তিত হতে থাকবে, শব্দের সংযোজন-বিয়োজন ঘটবে এবং ইতিহাসের স্রোতে ভাষা নিজেকে সংস্কার করবে। এই পরিবর্তন, সংস্কার ও স্রোত না থাকলে বাংলা ভাষা একদিন হারিয়ে যাবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোণা