× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ভারতের প্রথম রোহিঙ্গা নারী স্নাতক, যেমন ছিল এই দুর্গম যাত্রা

প্রবা প্রতিবেদন

প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৩ ১৬:৪৩ পিএম

আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৩ ১৮:১৫ পিএম

ভারতের প্রথম রোহিঙ্গা নারী স্নাতক তাসমিদা জোহর। ছবি : সংগৃহীত

ভারতের প্রথম রোহিঙ্গা নারী স্নাতক তাসমিদা জোহর। ছবি : সংগৃহীত

ভারতের প্রথম রোহিঙ্গা নারী স্নাতক তাসমিদা জোহর। বেশ আনন্দের বিষয় হলেও কদিন ধরে দ্বিধাপূর্ণ অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

‘প্রথম নারী, প্রথম স্নাতক, এই ধরনের শিরোনাম দেখলে আমি আনন্দিত হই। তবে একই সঙ্গে এতে আমার দুঃখবোধও হয়। আমি এসবে খুশি হই, কারণ এতদূর এগিয়ে আসাটা আমার প্রাপ্তি। কিন্তু আমিই প্রথম এটাও আমাকে দুঃখ দেয়। কারণ এত এত রোহিঙ্গা নারী যারা এ অবস্থানে আসতে চেয়েছিল, তারা কেউ তা পারেনি।’ রাজধানী নয়াদিল্লির একটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার কাছে একটি পার্কে বসে আল জাজিরার সঙ্গে এসবই বলছিলেন তাসমিদা।

ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছেন তিনি। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বাসিন্দা হওয়ায় ছোট থেকেই জীবনের প্রত্যেকটি বাঁকে নানা নিপীড়ন, অবহেলার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। তবুও থেমে থাকেনি তার যাত্রা। নিজের প্রচেষ্টায় স্নাতক শেষ করেছেন। এখন কানাডায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে চান তিনি। এরপর একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তাসমিদা। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গিয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের কথাও তুলে ধরতে চান ২৬ বছর বয়সি এ তরুণী।

মিয়ানমারে জন্মগ্রহণ করেন তাসমিদা জোহর। জন্মের পরে তাসমিন ফাতিমা নাম রাখলেও স্কুলে ভর্তির আগে তার নাম পরিবর্তন করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা-মাকে বাধ্য হয়ে আমার নাম পরিবর্তন করতে হয়েছিল। কারণ মিয়ানমারে বৌদ্ধ নাম না থাকলে স্কুলে ভর্তি হওয়া যায় না।’

শুধু তাই নয়, স্কুলে রোহিঙ্গা শিশুদের ওপর আরও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো। বৌদ্ধ ব্যতীত রোহিঙ্গারা কেউ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলে তাদের পুরস্কৃত করা হতো না। শ্রেণিকক্ষে রোহিঙ্গাদের জায়গা হতো একেবারে পেছনের সারিতে। রোল নম্বর বণ্টনের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। আগে বৌদ্ধ শিক্ষার্থী পরে রোহিঙ্গাদের শ্রেণি রোল দেওয়া হতো। এ ছাড়া স্কুলে হিজাব পরাও নিষিদ্ধ ছিল।

তবে এসব বৈষম্য কেবল যে শিক্ষার্থীদের করা হতো, তা নয়। রোহিঙ্গা কোনো ব্যক্তি ব্যবসা করছে জানলে কারাগারে নিয়ে নির্যাতন করা হতো।

তাসমিদা এ বিষয়ে বলেন, ‘আমার বাবা আমানুল্লাহ জোহরের ফল ও সবজি রপ্তানি ও বিক্রির ব্যবসা ছিল। প্রায়ই তাকে আটক করত পুলিশ। পরে তার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ছেড়ে দিত।’

একসময় দেশটিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বেড়ে যাওয়ায় তাসমিদার পরিবার ২০০৫ সালে মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে যায় কক্সবাজারে। সেখানে গিয়ে সবকিছু প্রথম থেকে শুরু করেন তারা। তার বাবা ৬৪ বছর বয়সে দৈনিক মজুরি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং তার মা ৫৬ বছর বয়সি আমিনা খাতুন স্থানীয় একটি কারখানায় কাজ শুরু করেন।

দেশত্যাগের আগে তাসমিদা মিয়ানমারে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল। তবুও বাংলাদেশে এসে তাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়েছিল। সেখানে নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর পাশাপাশি তিনি রোহিঙ্গা ও বার্মিজ ভাষা ছাড়াও বাংলা, উর্দু, ইংরেজি শিখতে শুরু করেন। এরপর ভারতে গিয়ে হিন্দিটাও আয়ত্ত করে নেন।

২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাসমিদার পরিবার। প্রথমে তারা উত্তর ভারতের রাজ্য হরিয়ানায় গিয়ে ওঠে। সেখানে যথাযথ শিক্ষার সুযোগ না থাকায় দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লির কালিন্দী কুঞ্জ ক্যাম্পে বসতি স্থাপন করে।

ভারতে গিয়েও তাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাসমিদাকে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোক বলে তাদের সব সময় ভয়ে তটস্থ থাকতে হতো।

তাসমিদা বলেন, ‘আমি চাইনি আমার স্কুলের সবার কাছে আমার পরিচয় জানুক। রোহিঙ্গা পরিচয়ে আমি কোনো বিশেষ চিকিৎসা বা সুবিধা পেতে চাইনি কখনও বা কেউ আমাকে সন্ত্রাসী বা অন্য নামে ডাকুক, সেটাও চাইনি।’

সেখানে স্কুলজীবন শুরু করাটাও ছিল তার জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন বাসে করে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতেন তিনি।

তাসমিদা বলেন, ‘বেশিরভাগ সময় বাসে বসার জন্য জায়গাও পাইনি। যদিও আমরা দেশে যা সহ্য করে এসেছি তার তুলনায় এসব কিছুই নয়। আর এত কষ্টের পরে যে সাফল্য আসে তার অনুভূতি একেবারে আলাদা।’

ভারতে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা নানা ভীতির কারণে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা করাতে চান না। তারা ভাবেন, তাদের মেয়েদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠালে সরকার তুলে নিয়ে যেতে পারে কিংবা তাদের অপহরণ, ধর্ষণ বা বিক্রি করে দেওয়া হতে পারে। মূলত বার্মায় ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার জন্যই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে সব সময় চিন্তিত থাকেন।

তবে একসময় তাসমিদার পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রতিবেশীরাও তার সফলতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছেন। বদলে গেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও।

তাসমিদা জানান, এখন তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তার আশপাশের বেশিরভাগ শিশুই স্কুল যাচ্ছে, কিংবা ক্যাম্পে বা হোম টিউশনের মাধ্যমে পড়াশোনা করছে বলেও জানান তিনি।

২১ বছর বয়সি মিজান হুসেন তাসমিদার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়া তরুণদের মধ্যে একজন। তিনি বলেন, ‘আমার মা আমাকে সমর্থন করার কারণ তাসমিদা। এখন আমার মা আমাকে বাইরে গিয়ে আরও পড়াশোনা করার অনুমতি দিয়েছেন।’

তাসমিদার মা আমিনা খাতুন চান তার মেয়ে আরও পড়াশোনা করে তাদের সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করুক। তিনি বলেন, ‘তাসমিদার সব অরক্ষিত ও নির্যাতিত নারী, শিশুদের কণ্ঠস্বর হওয়া উচিত। যারা নিজেদের হয়ে কথা বলতে পারে না তাদের সমর্থন করা উচিত। আমাদের মতো উদ্বাস্তুদের আমাদের সন্তানদের কাছে দেওয়ার মতো কিছু নেই। একমাত্র আমরা তাদের যা দিতে পারি তা হলো ‘তালিম’ (শিক্ষা)।’

অনগ্রসর ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআর-ডুওলিঙ্গো প্রোগ্রাম চালু করে। এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে নির্বাচিত ২৫ জন শরণার্থী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাসমিদা অন্যতম। তিনি বর্তমানে কানাডার উইলফ্রেড লরিয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাকস্পেটেন্স লেটারের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাসমিদা জানান, ভবিষ্যতে একজন মানবাধিকারকর্মী হতে চান তিনি।

দৃঢ় স্বরে তিনি বলেন, ‘আমি শিক্ষা ও নির্যাতিত নারীদের স্বাস্থ্যগত  অধিকারের জন্য লড়াই করতে চাই এবং অল্প বয়সি মেয়েদের পাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই। আমার স্বপ্ন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশার কথা জানানো। কারণ আমি মনে করি, রোহিঙ্গাদের এ দুর্দশা ও সত্য গল্পগুলো একজন রোহিঙ্গাই তুলে ধরতে পারে।’

ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গা। দেশটিতে ২০১৭ সালে নৃশংস সামরিক দমন-পীড়নের কারণে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতে পালিয়ে যান রোহিঙ্গারা। এর মধ্যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। যার কারণে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলা বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। যেখানে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে। অন্যদিকে জাতিসংঘে নিবন্ধিত প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে ভারতে।

২০১৪ সাল থেকে ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় এলে সম্প্রদায়টির বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো ও আক্রমণের মতো ঘটনাও ঘটে। গত বছর সরকার এমনও ঘোষণা দেয় যে মিয়ানমারে ফেরত না পাঠানো অবধি রোহিঙ্গাদের শিবিরে আটক রাখা হবে।

জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন বা এর ১৯৬৭ প্রোটোকল কোনোটাতেই সই করেনি ভারত। এ ছাড়া দেশটির জাতীয় শরণার্থীনীতিও নেই। যে কারণে শরণার্থী বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয় না দেশটি।


সূত্র : আল জাজিরা

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা