× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

এই দুক্কু শ্যাষ হয় না

প্রবা প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৩ ১০:৫৫ এএম

মেরিনা খাতুন

মেরিনা খাতুন

বাংলাদেশের জন্মসাথী মেরিনা। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা পচী বেওয়ার সন্তান। স্বাধীন দেশের মতো তিনিও অতিক্রম করেছেন পাঁচটি দশক। যুদ্ধশিশু পরিচয়টিকে বয়ে বেড়াচ্ছেন পাথর চাপা দেওয়া কষ্টের মতো। তার জীবনসংগ্রাম যেন এই দুঃখিনী বাংলা মায়েরই সুখ-দুঃখের প্রতিচিত্র। সেই সব সুখ-দুঃখ তিনি তুলে ধরেছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হৈমন্তী শুক্লা।

‘এখন তো বলে যুদ্ধশিশু। ছোটবেলা সবাই কইত জারজ। কইত তোর বাপ নাই, তুই জারজ সন্তান। কেউ খেলতে গেলে নেয়নি। স্কুলে গেছি, কইছে ওয়াকে সাথে নিও না। ও এইতা। মাইনসের বাড়ি কাম কইরা খাইছি, ভাত পাইনি। মা থুইয়া দিছে, মাইনসের বাড়ি ছাওয়া (ছেলে-মেয়ে) রাইখা খাইছি। অনেক শিক্ষিত মাইনসেও এখনও এমন করে। দুক্কু, জীবনভর খালি দুক্কু... এই দুক্কু শ্যাষ হয় না। খালি বাড়তেই নাগছে।’

বলছিলেন তাড়াশের মেরিনা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার মা পচী বেওয়া ছিলেন মধ্যবয়সি। স্বামী না থাকায় ছয়টি সন্তান বড় করে তোলার ভার ছিল পুরোপুরি তার ওপর। এর মধ্যেই একদিন রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায় পচীকে। আটকে রাখে পাকিস্তানি সেনাদের ডেরায়। প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলে তার ওপর। দিনের পর দিন ধর্ষণের শিকার হন তিনি। মাসখানেক বাদে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।

চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন পচী বেওয়া। একদিকে ছয় সন্তানকে মানুষ করে তোলার দায়িত্ব, অন্যদিকে এই শারীরিক-মানসিক ট্রমা তাকে অস্থির করে তোলে। এরই মধ্যে বুঝতে পারেন শরীরের মধ্যে বেড়ে উঠছে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারের ফসল। ঘরে ফিরেও তাই শান্তি মেলে না তার। চারপাশে শুরু হয় ফিসফিস। সবার আঙুল পচীর দিকে- ‘বিধবা মেয়ের সন্তান হচ্ছে’। কেউ জোরে জোরেই শোনায়, ‘পাকিস্তানিদের সন্তান’; অথচ কেউ বলে না, এ-ও মুক্তিযুদ্ধেরই অংশ, বলে না, এই শিশু এ দেশেরই সন্তান। 

অপমান, অভিমান, লজ্জা ও ঘেন্নায় পচী বিদায় নিতে চাইলেন পৃথিবী থেকে। তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিষপান করে চেষ্টা চালালেন আত্মহত্যার; কিন্তু বেঁচে গেলেন প্রকৃতির কী এক অপার রহস্যময়তায়। এমনকি পেটের সন্তানেরও কোনো ক্ষতি হলো না। ছয় মাস পর সুস্থ-সবল মেয়েশিশু মেরিনাকে জন্ম দিলেন তিনি। 

মেরিনা জানালেন, দেশ স্বাধীন হলেও সেই আনন্দের ছোঁয়া স্পর্শ করেনি তাদের জীবনকে। অপবাদ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে কেটেছে শৈশব-কৈশোর। চারপাশের আর পাঁচটা ছেলে-মেয়ের মতো হেসে-খেলে বড় হতে পারেননি তিনি। যেখানেই গিয়েছেন, শুনেছেন লোকজন বলাবলি করছে, ‘পাকিস্তানিদের সন্তান’। সবার চোখেমুখে অবহেলা, তাচ্ছিল্য। এ কারণে স্কুলেও পড়া হয়নি তার। 

একপর্যায়ে সামাজিক চাপে মা মেরিনার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তখন মায়ের ওপর খুব রাগ হতো তার। কিন্তু মেরিনা নিজেও এখন চার সন্তানের মা। তিনি জানালেন, নিজের জীবন দিয়ে এখন তিনি মায়ের সেসব দিনের কষ্ট বুঝতে পারেন। মা-মেয়ের সেই বিচ্ছেদের জন্য এখন তিনি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘এখন যেমন আমাকে মানুষজন নানা কথা বলে, আমি সহ্য করি, মাকেও তো তেমনি বলেছে। কিন্তু দোষ কি আমার? অনেকে মাকে বলেছে, বিদেশে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু আমি তো বাংলাদেশের, আমি আরেক দেশে যাব কেন?’

বিয়ের পরে মেরিনার যেন স্বস্তি মেলে। শ্বশুরবাড়িতে স্বামী ও শাশুড়ি ছাড়া আর কেউই তার জন্মপরিচয় জানতেন না। কিন্তু সেই সুখও বেশিদিন কপালে সইল না। মেরিনা জানান, ২০০৫ সালে মা মারা গেলেন। বেঁচে থাকতে তিনি কোনো স্বীকৃতি পাননি। কয়েক বছর পর এক মুক্তিযোদ্ধা তাদের বললেন, মা পচী বেওয়াকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করতে। সে অনুযায়ী আবেদন করার পর ২০১৮ সালে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মেলে পচী বেওয়ার।

এরপরই নানা নাটকীয়তার আবর্তে পড়ে যান মেরিনা। কারণ বাবার নাম হিসেবে পচী বেওয়ার মৃত স্বামীর পরিচয় বহন করতেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধশিশু হওয়ার কারণে তার পরিচয় সংক্রান্ত পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০১৮ সাল থেকে অনেক সংগ্রামের পর গত বছর জাতীয় পরিচয়পত্রের সংশোধনীতে তিনি তার বাবার নাম ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে রেকর্ড করাতে সক্ষম হন। মেরিনাই প্রথম যুদ্ধশিশু যিনি পিতার নাম ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এরপর বিভিন্ন পত্রিকা ও গণমাধ্যমে মেরিনার কথা উঠে আসে। যে পরিচয় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, তা নতুন করে জেগে ওঠে। নতুন করে গঞ্জনার মুখোমুখি হতে হয় তাকে।

মেরিনার স্বামী মহম্মদ ওমর আলী। জীবনের নানা সংকটে সঙ্গীকে আগলে রেখেছেন সবটুকু দিয়ে। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পরে আমাকে অনেকে কইছে, কী বিয়া করলি? যে আমার ভাগ্যে ছিল তারে পাইছি। বাচ্চা হওয়ার পর এই কতাডা মিট্যাই গেছিল। এরপর আমার শাশুড়ি ২০১৮ সালে যহন বীরাঙ্গনা খেতাব পাইল, তখন দেশ জুইড়া জানাজানি হইল। আমাগো ছাওলা-পানদেরও (ছেলে-মেয়ে) কথা শুনতে হয়।’

ওমর আলী বলেন, ‘জন্মের পর থাইক্যা মেরিনা অনেক কষ্ট সহ্য করছে। আমার সংসারও টানাটানির। ভ্যান চালাইছি। অন্য কাম করছি। এখানেও মেরিনার সুখ হয় নাই। তার ওপর এহন সামাজিক উৎপাত। এখন ছাওয়াল-পাল যাতে খানিকটা সম্মান নিয়া থাকতে পারে হেইডাই চাই।’ 

মেরিনার কাছ থেকে জানা গেল, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ইউনিয়নে ১৯৯৪ সালে স্বামীর কষ্টের টাকায় একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় তাদের। নিজেদের কেনা জমিতে চার সন্তান নিয়ে সেখানেই বাস করছেন তারা। সম্প্রতি সরকার থেকে পচী বেওয়ার নামে একটি একতলা পাকা ঘর তোলার জন্য জায়গা বরাদ্দ করা হয়। ঘর নির্মাণের জন্য মাপজোকও হয়। তখনই দেখা দেয় নতুন সমস্যা। অন্য একটি পক্ষ দাবি করে বসে, যুদ্ধের আগেই এই জায়গা মালিকের কাছ থেকে তারা কিনে নিয়েছিলেন। তবে দলিল দেখাতে পারলেও খাজনা, পর্চাসহ অন্যান্য কাগজ তারা দেখাতে পারেননি বলে জানান মেরিনা। এ নিয়ে মামলা চলমান থাকায় স্থগিত রয়েছে সেই বাড়ি নির্মাণের কাজ।

মেরিনা জানান, যে বাড়িতে তিনি আছেন, সেটির দুই দিকেই পুকুর। ছোট একটু জায়গায় গড়ে তোলা একতলা এই বাড়িটি যেকোনো সময় ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ রড ছাড়াই বানানো হয়েছে এটি। তাছাড়া এইটুকু জায়গায় তিন সন্তান নিয়ে তাদের থাকাও কষ্টকর। তিনতলা ফাউন্ডেশন দেওয়া একটি বাড়ি করতে পারলে খানিকটা স্বস্তিতে থাকতে পারবেন তিনি। মেরিনার বড় ছেলে চায়ের দোকান চালায়, মেজোজন ভ্যানচালক। আর ছোটজন এ বছর এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে ভাইয়ের সঙ্গে সে-ও প্রায়ই চায়ের দোকানে কাজ করে। একটিই মাত্র মেয়ে তাদের, বিয়ে হয়ে গেছে। 

আজন্ম কষ্টের জীবনে মেরিনা চান যোগ্য সম্মান। একটু নিশ্চয়তা। স্বামী-সন্তান, নাতি-নাতনি নিয়ে জীবনের বাকি পথটুকু কাটাতে চান সুখে ও স্বস্তিতে। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা