তৌহিদুল ইসলাম তুষার
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৩ ১০:৫৩ এএম
আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৩ ১৪:১০ পিএম
বিবি রাসেল।
বাংলাদেশি শীর্ষ মডেল ও ডিজাইনারের কথা এলে সবার আগে আসে বিবি রাসেলের নাম। ’৯০-এর দশকে তিনি বাংলাদেশের নাম বিশ্বদরবারে উজ্জ্বল করেন। আন্তর্জাতিক মডেল হিসেবে কাজ করছেন বিশ্বখ্যাত সব ফ্যাশন ম্যাগাজিন এবং ব্র্যান্ডের সঙ্গে।
ইউরোপে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করার পরেও তিনি ফিরে এসেছেন দেশে। একাই সামলে যাচ্ছেন নিজের হাতে গড়া ‘বিবি প্রোডাকশন’। কাজ করছেন দেশের তাঁতিদের নিয়ে। অর্জন করেছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য সম্মাননা এবং স্বীকৃতি।
দেশীয় সংস্কৃতিকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করে আরও এগিয়ে যেতে চান এই শিল্পী। অনন্য গুণের অধিকারী বিবি রাসেলের সঙ্গে কথা বলেছেন তৌহিদুল ইসলাম তুষার
প্রশ্ন : আপনি বেড়ে উঠেছেন বাঙালি পরিবারে। মডেল এবং ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার পেছনে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু ছিল?
উত্তর : আমার এই অর্জনের পুরোটাই আমার পরিবার এবং দেশের। ছোট থেকে একটা মিক্সড কালচারে বড় হয়েছি। বাবার বাড়ি চট্টগ্রামে আর আমার মায়ের বাড়ি ছিল নর্থ বেঙ্গল। বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের লোকের আনাগোনা ছিল সব সময়। কবি, সাহিত্যিক, সংগীতশিল্পী, লেখক সবাই আসতেন। আমি তাদের দেখতাম, শিখতাম। যেগুলো দেখেছি সেগুলো আমার চোখের মধ্যে আছে। ঘরের সাপোর্ট ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। বাবা-মা আমাকে স্বপ্ন দেখার সুযোগ দিয়েছেন।
স্বপ্ন শুধু রাতে নয়, দিনের বেলায়ও দেখতাম। তখনকার দিনে কিছু লোক বাড়ি বাড়ি গিয়ে তরিতরকারি, মাছ-মাংস বিক্রি করত। আমি বসে বসে তাদের পোশাক দেখতাম। মেয়েদের দেখলে জিজ্ঞেস করতাম, তার পরনের শাড়ি কে বানিয়েছে? বলত গ্রামের মানুষরাই। আমি অবাক হতাম। তখন বাবা-মাকে বলতাম আমার তো সবই আছে। পেন্সিল আছে, রঙ আছে। তাহলে ওরা কীভাবে আমার থেকে সুন্দর কাপড় বানায়। তখন থেকেই গ্রামের মানুষ আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। আমার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটাও বড় হয়েছে। আমি দুনিয়া ভুলে স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছি। ঢাকার আজিমপুরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে অধ্যয়ন শেষ করে লন্ডন যাই ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়তে।
প্রশ্ন : সেই সময়ে লন্ডনে ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়তে যাওয়া নিশ্চয় সহজ ছিল না। সেই জার্নি সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : ১৯৭২ সালে লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে যোগ দিই। ক্লাস শুরুর ছয় মাস আগেই চলে যাই। কিন্তু ইংরেজি পাঠ্যক্রমের কোনো সার্টিফিকেট না থাকায় ভর্তিতে সমস্যা হয়। প্রতিদিন অফিসে ফোন দিতাম, একসময় কয়েকজন প্রার্থীকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। সেখানে বাংলাদেশের পোশাক, ডিজাইন, ফ্যাশন নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা না থাকায় কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হই। এ সময় অতিরিক্ত ক্লাসে অংশ নেওয়ার শর্তে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রতিদিন ভোর ৪টায় উঠে প্রস্তুতি নিতে হতো সারা দিনের। অতিরিক্ত ক্লাস করে রাতে ফিরতে হতো।
প্রশ্ন : মডেল হলেন কীভাবে?
উত্তর : ১৯৭৫ সালে গ্র্যাজুয়েট শেষ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইনফ্লয়েন্সে, বিখ্যাত মডেল এজেন্ট ল্যারেইন এশটনের সঙ্গে কাজ শুরু করি। মডেলিংয়ের কোনো ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ফ্যাশনজগৎ সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য কাজ করতে আগ্রহী হই। প্রথম মডেলিং ছিল ইতালীয় ডিজাইনার ভ্যালেন্তিনোর সঙ্গে। এটা ঠিক যে মডেলিং আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। মডেলিং আমাকে স্বাধীন করেছে, ম্যাচিউর করেছে, দেশ চিনিয়েছে, বিভিন্ন ভাষা শিখিয়েছে। বিশ্ব মিডিয়াতে প্রাইসলেস সাপোর্ট দিয়েছে।
প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক মডেল হিসেবে কাজ করতে কেমন লেগেছে?
উত্তর : এক কথায় অবাক লেগেছে। সাধারণত বড় গাড়ির মডেল করা হতো ব্রাউন ব্লু চোখের মেয়েদের। আমাদের যখন ডাকা হলো একটু অবাক হয়েছি। আমি তাদের বলতাম এটাও কি সম্ভব! তারা বলল সত্যিই চায়। তখন বুঝলাম আমার প্রতি তাদের কিউরিসিটি আছে। বাংলাদেশের একটা মেয়ে হয়ে সেখানে টপ গাড়ির বিজ্ঞাপন করেছি। যেমন রোলস রয়েলস, বিএমডব্লিউ, জাগুয়ার সব। এত কিছু ছেড়ে আমি এদেশের গ্রামের মানুষের জন্য এসেছি। আমাকে তারাই বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের জন্যই আমি বিবি রাসেল।
প্রশ্ন : এত অর্জন থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরে এলেন কেন?
উত্তর : আগেই বলেছি মডেলিং আমার স্বপ্ন ছিল না। ওটা দিয়ে আমার নিজের আয় করেছি। এখন যে বিবি প্রডাকশন দেখছেন, সেটা আমার অর্থায়নেই চলছে। দেশে এসে অন্য কিছু করিনি যে আমি অনেক টাকার মালিক হব। তখন মডেলিংয়ের পয়সাই ছিল আমার মূলধন। বিদেশের চাকচিক্য আমাকে কখনও টানেনি। আমি সেখানে থেকে নিজেকে তৈরি করেছি। ১৯৯২ থেকেই বন্ধুদের বলতাম আমি দেশে ফিরে যাব। তারা বলত কেন চলে যাবে? আমি কোনো উত্তর দিতাম না। সবকিছুতেই চুপ থাকতাম। আমি শুধু মেনটালি আর ফিজিক্যালি নিজেকে তৈরি করেছি। আমি সব সময় বলতাম নিজের কাছে ‘আমার স্বপ্নের চেয়ে বেশি কিছুই হবে না।’ একটা গ্রামে গেলে আমার সঙ্গে ৫০-১০০ লোক হেঁটে হেঁটে কথা বলে। সবাই জিজ্ঞাসা করে, আপা কী খাবেন। এটা কোনো দেশেই পাব না। এখনও বিদেশে গেলে যেদিন কাজ শেষ হয়, তার পরের দিনই প্লেন ধরি।
প্রশ্ন : ১৯৯৪ সালে যখন এদেশে কাজ শুরু করেন, তখন কতটুকু স্ট্রাগল করতে হয়েছিল?
উত্তর : এখনও স্ট্রাগল করছি। ১৮ ঘণ্টা কাজ করি। স্ট্রাগল মানুষকে শক্ত বানায়। অনেকে ভাবেন আমি এত বছর ধরে কাজ করি কিন্তু আমার শোরুম বা দোকান এত কম কেন। আমি তো দোকানদার হতে আসিনি। আমি এসেছি এই সেক্টর এবং তার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উন্নয়ন করতে। আমি অনেক দেশে কাজ করি, আমার পুরো রিসার্চের খরচ সেই দেশ দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে সম্পূর্ণ নিজের করতে হয়। আমার তৈরি কাজের সবই দেশের উপকরণ দিয়ে তৈরি। আমি ফিরে আসার পরে অনেকেই ভালো করেছে। তারা একটার পর একটা বাড়ি কিনে ফেলে, গাড়ি কেনে। অনেক বড় ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে আসে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি দেশি কালচার নিয়ে কাজ করছি।
প্রশ্ন : আপনি ফ্যাশনে শুধু গামছা নিয়ে কাজ করছেন, কেন?
উত্তর : ছোটবেলা থেকেই অনেক রঙের কম্বিনেশন দেখতাম। গ্রামের মানুষের এত ভালো রঙের ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করত। এখনও অনেকে বলে ওদের শিক্ষা নাই, তারপরও এত ভালো কাজ। আর যদি তাদের আমার মতো সুযোগ হতো তবে কোন পর্যায়ে চলে যেত। এক কথায় জিনিয়াস। গামছার মধ্যে যতটা ভেরিয়েশন আনা যায়, যা চিন্তার বাইরে। আমার ভালো লাগত। তাই আমার এত এত কাজের সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে গামছার তাঁতিদের।
প্রশ্ন : আপনি এত স্টাইলিশ। আপনার ফ্যাশন আইকন কে?
উত্তর : আমার ফ্যাশন আইকন রবিঠাকুর। তিনি খুবই স্টাইলিশ ছিলেন। তিনি যখন ভ্রমণ করতেন, তখন সাইট পিন স্ট্রাইপ জ্যাকেট, জাপানে কিমোনো আবার তুর্কিতে গেলে টার্কিস হ্যাট পরতেন। আমি তার সব ছবি সাদা-কালো দেখেছি। যখন শান্তিনিকেতনে গিয়েছি নিজে ইমাজিন করে কালার দেখতাম।
প্রশ্ন : আপনার লক্ষ্য ছিল তাঁতশিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। সেটি কতটা সফল হলো?
উত্তর : কোনো একটা শিল্প ওঠাতে গেলে সেই দেশের মানুষের বেশি সদিচ্ছা থাকতে হয়। আমি বলব আমরা যদি দশটা কাপড় কিনি তাহলে যেন অন্তত দুটি দেশি পোশাকও নিই। এটা কিন্তু সব দেশে আছে। পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে যদি আমরা একটা শাড়ি বানাতে পারি, যেটা কি না ম্যাচ বাক্সে ঢুকে যায়। তাদের তো আরও ভালো জায়গায় থাকার কথা ফেব্রিক অঙ্গনে। কোনো দেশের শিল্পকে ওঠাতে গেলে জাতীয় পর্যায় থেকে একটা সাপোর্টের প্রয়োজন আছে।
প্রশ্ন : পোশাকশিল্পের দিক থেকে দেশীয় ফ্যাশন হাউস এখনও খানিকটা পিছিয়ে, এর কারণ কী মনে করেন?
উত্তর : সবচেয়ে বড় বিষয় সাপোর্ট। আমি বিদেশে বড় হয়েছি তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। সবকিছু নিজের যোগ্যতায় করেছি। কেউ আমাকে স্পন্সর করেনি। কিন্তু বাইরের দেশে সবাই স্পন্সর নিয়ে পড়তে যায়। এখনও আমি কোনো অনুষ্ঠানে গেলে খেয়াল করি, কয়জন আমাদের দেশের কাপড় পরে। আমাদের দেশের পোশাকশিল্পকে উন্নত করতে আন্তর্জাতিক মানের ডিজাইনার তৈরি করতে হবে। দেশের মানুষকেও ভূমিকা রাখতে হবে। বেশি বেশি দেশি পোশাক কিনতে হবে।