নিরাপত্তা
ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:৩৫ পিএম
আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:০৪ পিএম
রাজধানীতে নারীদের জন্য বাসে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। বুধবারের ছবি
অনেক রাত। অন্ধকারে আমি একা দাঁড়িয়ে ভয়ে কেঁদেছিলাম সেদিন। একটার পর একটা বাস গেলেও আমাকে তোলেনি। যানজটের কারণে সেদিন রাত ১১টায় গাজীপুর নেমে গেছি। কিছু পথ হেঁটে আর বাস পাচ্ছিলাম না। পরে বাসের হেলপারকে খুব অনুরোধ করে বাসে উঠেছি। এ ঘটনা ২০১৬ সালের। বলছিলেন বাড্ডার বাসিন্দা সাদিয়া সেতুল। সে সময় একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন তিনি।
তবে সাত বছরে কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাতেমাতুজ্জোহরা মৌ। চাকরি করার পর থেকে প্রতিদিনই রাত হয় বাসায় ফিরতে। প্রতিদিনই ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে হয়।
তিনি বলেন, ‘বাস পেতে দেরি, রাস্তায় যানজট—সবমিলে বাসা থেকে খুব সকালে বের হতে হয়। বাসে ওঠানামা নিয়ে হয়রানি হতেই হয়। প্রায়ই বাসে ভিড় থাকে, সামনের দিকে গাদাগাদি করে পুরুষদের সঙ্গে দাঁড়াতে হয়। পুরুষদের কাছে লাঞ্ছিত তো হই-ই, আবার পুরুষরাই হেলপারকে বলে, এই মহিলা তুলবি না! শুনে খুব কষ্ট হয়।’
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অনন্য মিত্র পূজা। সম্প্রতি পড়াশোনার জন্য ঢাকায় এসেছেন।
তিনি বলেন, ‘প্রায় প্রতিদিনই এমন কিছুর সম্মুখীন হতে হয়। এ ছাড়া নানাভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা তো থাকেই। নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু রাস্তায় নারীর চলাফেরা সহজ করে তোলা হয়নি। বাসে ওঠায় না শুধু তা নয়; বাসে নারীর শব্দও যেন কেউ শুনতে পায় না—এমনভাবে থাকতে হয়।' বলছিলেন প্র্যাক্সিসের সদস্য মিরপুরের বাসিন্দা ডালিয়া চাকমা।
সম্প্রতি নারীদের জন্য বাসে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে আলাদা বাসের ব্যবস্থা। সেই সঙ্গে সব বাসে আলাদা সিটের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তবু সংকট কাটছে না। দেখা গেছে, নারীরা বাসে উঠতেই পারছেন না। বলছিলেন নারী অধিকারকর্মী মার্জিয়া প্রভা।
তিনি বলেন, ‘সিসি ক্যামেরা লাগানোর পর আমরা দেখলাম আসলে নারীরা বাসেই উঠতে পারছে না। এ ছাড়া আলাদা বাসই-বা কেন লাগবে? পুরুষ ও নারী সহযাত্রী হয়েই তো বাসে যেতে পারে। পুরুষদের সেভাবে শিক্ষা দিতে হবে যেন তারা কোনো নারীর সঙ্গে অপ্রত্যাশিত আচরণ না করেন। নারীকেও সাহস অর্জন করতে হবে।’
রাজধানীতে নারীদের বাস সার্ভিস নতুন কিছু নয়। বিআরটিসির সাতটি বাস নারীদের জন্য বিভিন্ন রুটে চলছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে বিভিন্ন রুটে চলছে নারীদের বাস ‘দোলনচাঁপা’।
তবে নারীরা বলছেন, তারা এসব বাসের দেখা পান না রাস্তায়। এ ছাড়া প্রতিটি বাসে মেয়েদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টা সিট। কখনও কখনও সেসব সিটে পুরুষ যাত্রীদের বসে থাকতে দেখা যায়। কাউন্টার বাসের ক্ষেত্রে সামনের তিন সারি শিশু, নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য রাখা হয়েছে। তিন সারিতে ৯ জন বসতে পারে। বাকি আসন পুরুষের জন্য রাখা হয়েছে। এখানেও নারীরা বৈষম্যের শিকার। লোকাল বাসের পাঁচ থেকে ছয়টি সিট পূর্ণ হলে নারী যাত্রীদের বাসে উঠতে দেওয়া হয় না।
আলাদা বাসে নারীদের সমস্যার সমাধান কি আদৌ সম্ভব? সরকারি কিংবা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় নারীর জন্য পৃথক পরিবহনের চাহিদা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন অনেকে।
বিআরটিসির জেনারেল ম্যানেজার আমজাদ হোসেন বলেন, বিআরটিসির সাতটি বাস অফিসের সময় মোহাম্মদপুর, গুলিস্তান, মতিঝিলে চলাচল করে। তবে শুধু নারীদের জন্য সারা দিন এ বাসগুলো সার্ভিস দেয় তা না। বাকি সময় এ বাসগুলো গণপরিবহনে পরিণত হয়। শুধু নারীদের জন্য বাস চলাচল করলে লোকসানের মুখে পড়তে হয়। সেজন্যই বিকল্প এই ব্যবস্থা।
তিনি বলেন, ‘তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। আমরা আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মেয়েদের বাসে উঠতে না দেওয়ার বিষয়টি মাথায় রাখছি। এটা সত্যিই অনেক বড় একটা সংকট। আমরা বিষয়টি দায়িত্বরতদের কাছে পৌঁছে দেব। ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’