প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪ ২১:৫৪ পিএম
লন্ডনে সৌধের আয়োজনে জীবনানন্দ উৎসবে অতিথিরা। প্রবা ফটো
সৌধ সোসাইটি অব পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মিউজিকের আয়োজনে ইস্ট লন্ডনে জীবনানন্দ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। পঞ্চমবারের মত আয়োজিত এই উৎসবকে কবি জন ফার্নডন বলছেন, ‘এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন বর্ণের ও গোত্রের দর্শকদের উপস্থিতিতে বিস্ময়কর সব সাহিত্য পরিবেশনা দিয়ে নতুন সাহিত্য-তরঙ্গ নির্মাণের এক উজ্জ্বল প্রয়াস।’
আবার বিবিসি স্লাম চ্যাম্পিয়ন কবি ডেভিড লী মর্গান বলেছেন, ‘এক সত্যিকার আন্তর্জাতিকতা-মনস্ক ধ্রুপদী সাহিত্য-উৎসব এটি। সৌধের এই আন্তর্জাতিক-মনস্কতার কারণে গত দশ বছর থেকেই আমি নিজেকে সৌধের একজন হিসেবেই ভেবে আসছি।’
শুক্রবার (১ মার্চ) অনুষ্ঠিত জীবনানন্দ উৎসবকে ‘লন্ডন নগরীতে এক নতুন সাহিত্য প্রবণতা’ হিসেবে দেখছেন দর্শক ও শিল্পীরা। লন্ডনের রিচমিক্স থিয়েটারে হলভর্তি দর্শকেরা উপভোগ করেছেন রবীন্দ্রোত্তর বাংলাভাষার প্রধানতম কবি জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকীর্তি নিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ ঘন্টার ‘অসামান্য আর বিচিত্র’ সব পরিবেশনা। অনুষ্ঠান শেষে মোহাবিষ্ট দর্শকেরা এমনই উচ্ছ্বাস ও মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
বৃটিশ-ফরাসী দর্শক ফ্লোরা নিকলসন বলেন, আমি আক্ষরিক অর্থেই কাঁপছি, বর্ণনা করার সব ভাষা হারিয়ে ফেলছি। গত শতকের একজন কবি আজকের পাঠক ও লেখকদের জন্যেও কতটা প্রেরণা বহন করতে পারেন, কতটা শক্তিশালী ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেন, এই উৎসবে না আসলে আমার জানা হত না। সাড়ে ৩ ঘন্টার এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে ও সৌধের কাজের একনিষ্ঠ অনুরক্ত হয়ে আমি বাড়ি ফিরছি।’
মিশরীয় কবি মোহসেন মহাম্মেদ বলেন, ‘আমি এই উৎসবে প্রথমবারের মত অংশগ্রহণ করেছি। জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ কবিতাটি আরবিতে অনুবাদ করে এখানে পাঠ করেছি। অনুবাদ করতে গিয়েই এই মহান কবির প্রেমে পড়ে গেছি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দের নানা রকমের সাহিত্যকৃতি নিয়ে হৃদয়স্পর্শী সব মঞ্চায়ন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করেছি। বিশেষ করে বুলগেরিয়ান পার্শিয়ান, রোমানিয়ান, স্পানিশ ও পোলিশ ভাষায় অনূদিত কবিতার পরিবেশনা এবং উৎসবে শেষের দিকে মঞ্চস্থ দুটো কাব্য-একাঙ্কিকা। কবিতা নিয়ে এমন অপূর্ব থিয়েটারের ধারণা আর এমন স্বর্গীয় কন্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে আমি ইতোপূর্বে কখনো পরিচিত হইনি।’
ইরানিয়ান কবি,অনুবাদক ও একাডেমিক আলিরেজা আবিজ বলেন, ‘উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি অভিভূত ও সম্মানিতবোধ করছি। পার্শিয়ান ভাষায় আমি আরও অনেক বেশি জীবনানন্দ অনুবাদ করতে চাই। সারাবিশ্ব বাঙালি এই কবির অসামান্য সাহিত্যকর্ম নিয়ে জানা উচিত। আমি জানি সামনের বছরগুলোতে আরও অনেক বেশি বৃটিশ-ইরানী দর্শকেরা এতে উপস্থিত থাকবেন। সৌধের হয়ে আজকের এই বার্তা নগরীর দূরতম কোণগুলোয় শিল্পপিপাসুদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’
লেখক ও লিটলম্যাগ সম্পাদক সোমন্ত মোহান্ত বলেন, ‘এত সংখ্যক অবাঙালী দর্শকদের সামনে, আবার এই মাপের বাঙালি/অবাঙালি কবি ও শিল্পীদের নিয়ে শুধু জীবনানন্দের উপর সাড়ে ৩ ঘন্টার এহেন বিশ্বমানের উদ্যোগ আমার মনে হয় না ভারত উপমহাদেশের কোথাও এ মুহূর্তে এমনকি কল্পনাও করা যাবে। কলকাতা এবং বাংলাদেশেও এই উদ্যোগের খবর পৌঁছে দেওয়া উচিত। সম্ভব হলে ওখানেও এই উৎসব ছড়িয়ে দিতে হবে।’
তিনি বলেন, জীবনানন্দ নিয়ে এইসব অভূতপূর্ব পরিবেশনার পাশাপাশি তার সাহিত্যকৃতি নিয়ে রচিত গবেষণাকর্ম প্রচার এবং প্রতীচ্যের একাডেমিকদের মধ্যে জীবনানন্দ নিয়ে নতুন নতুন গবেষণায় আগ্রহী করে তোলার দায়িত্বটুকুও সৌধ গ্রহণ করতে পারে। তাতে উৎসবের কলেবরে আরও বৈচিত্র্য আসবে। একদিনের পরিবর্তে যদি এটি সপ্তাহব্যাপী বর্ধিত করা যায়, এর ফলও সুদূরপ্রসারী হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
বৃটিশ-বুলগেরিয়ান কবি ও প্রত্নসঙ্গীত গবেষক ড. স্নেজহিনা গুলুবভা বলেন, বুলগেরিয়ান ভাষায় জীবনানন্দের বনলতা সেন অনুবাদ করে যেমন আনন্দ পেয়েছি, প্রিয়বন্ধু কবি আহমেদ কায়সারের সঙ্গে মিলে এই কবিতা হলভর্তি শিল্পরসিক দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করে দ্বিগুন আনন্দ পেয়েছি। অনুষ্ঠান শেষে দর্শকদের অনেকেই আমাদের পরিবেশনা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছেন। তা আমাকে আপ্লুত করেছে। আমার বেশ কিছু বন্ধু যারা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের সবাই কবিতা, সঙ্গীত নৃত্য ও পোয়েট্রি থিয়েটারের মত অভিনব শিল্প-প্রকল্প নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।’
বৃটিশ সঙ্গীতশিল্পী জেসিকা ফার্লি বলেন, ‘পুরো সন্ধ্যা আমি অভিভূত ছিলাম কবিতার সঙ্গে বিস্ময়কর গায়নের অর্থপূর্ণ এক মেলবন্ধন আবিষ্কার করে। আমার জন্যে এই ধারণা নতুন নয় তবে পরিবেশনার মাত্রা, প্রকরণ ও মঞ্চায়ন ছিল একেবারেই নতুন। ভারত থেকে আসা ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী কোয়েল যতবারই কন্ঠ দিয়েছেন আমি রীতিমত শিউরে উঠেছি গানের নাটকীয়তা ও গভীরতায় হারিয়ে যেতে যেতে।
বৃটেনে দক্ষিণ-এশীয় শিল্পের শীর্ষতম সংস্থা সৌধ সোসাইটি অব পোয়েট্রি এন্ড ইন্ডিয়ান মিউজিকের উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসবে বিভিন্ন ধরণের পরিবেশনায় অংশ গ্রহণ করেন প্রথিতযশা বাঙালি ও অবাঙালি কবি, লেখক, তাত্ত্বিক এবং সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয়শিল্পীরা।
এতে জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার এক অভিনব সঙ্গীত-ভাষ্য উপস্থাপন করেন কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক জন ফার্নডন। জীবনানন্দের কবিতার বুলগেরিয়ান অনুবাদ ও আনুষঙ্গিক আলোচনায় অংশ নেন বুলগেরিয়ান কবি ও প্রত্ন-সঙ্গীত গবেষক ড. স্নেজহিনা গুলুবভা। স্ব-অনুদিত পার্শিয়ান অনুবাদ পাঠ করবেন বিশিষ্ট বৃটিশ-ইরানী কবি আলিরেজা আবিজ এবং আরবি অনুবাদ পাঠ করবেন তরুণ বৃটিশ-মিশরীয় কবি মোহাম্মদ মোহসেন।
আবৃত্তি ও নৃত্য দিয়ে জীবনানন্দের কবিতার হৃদয়স্পর্শী উপস্থাপনা মঞ্চায়ন করেন কাউন্সিলর জাসমীন চৌধুরী, কবি তানজনা নূর-ই সিদ্দীক, ডা. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, আবৃত্তিকার পপি শাহনাজ, উর্মি মাজহার, ছান্দসিক প্রতিষ্ঠাতা মুনিরা পারভীন, সৈয়দ আনোয়ার রেজা, প্রপা রেজোয়ানা আনোয়ার, ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পী মনিদীপা শীল, শীতেষ্ণা বোস, শর্মিষ্ঠা পন্ডিত, এষা চক্রবর্তী ভট্রাচার্য ও বাংলাদেশ থেকে আসা মনিরুল ইসলাম মুকুল।
বৃটেনের বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তীর সুরারোপিত জীবনানন্দের কবিতা দিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী লাবনি বড়ুয়া। নিজের সুর করা ‘শঙখমালা’ কবিতার ব্যতিক্রমধর্মী পরিবেশনা উপস্থাপন করেন শিল্পী সুহা প্রিয়দর্শিনী চক্রবর্তী। কবিতার সঙ্গে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক রাগসঙ্গীত পরিবেশন করেন ভারত থেকে আসা উস্তাদ রাশিদ খানের সঙ্গীতশিষ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী কোয়েল ভট্রাচার্য।
উৎসবের শেষের দিকে পরিবেশিত হয় টি এম আহমেদ কায়সার নির্দেশিত জীবনানন্দের ‘হায় চিল!’ ও ‘কুড়ি বছর পর’ কবিতার উপর নির্মিত অভিনব পোয়েট্রি থিয়েটার। কবি সারওয়ার ই আলম, অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী শিউলি ভট্রাচার্য, কবি ও আবৃত্তিশিল্পী তানজিনা নূর-ই সিদ্দিকী, সংগঠক জাসমীন চৌধুরীর সঙ্গে কন্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করেন কোয়েল ভট্রাচার্য। চিত্রশিল্পী সোনিয়া ইয়াসমীনের চিত্রশিল্প ও জীবনানন্দের কবিতা শীর্ষক এক অভিনব দৃশ্য-পাঠ যৌথভাবে উপস্থাপন করেন সাংবাদিক কাজী জাওয়াদ ও চিত্রশিল্পী সোনিয়া ইয়াসমীন।
সৌধ পরিচালক টি এম আহমেদ কায়সার বলেন, উৎসব শেষ হয়ে যাবার পর এখনও দর্শক এবং শিল্পীমহল থেকে অব্যাহত প্রশংসা পেয়ে আমরা খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করছি। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের পরে যে কবিকে বাংলা বা সর্বভারতীয় কবিতার যথার্থ উদাহরণ, একটা স্বাদ বা আস্বাদ হিসেবে আমরা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করতে পারি তিনি হলেন জীবনানন্দ দাশ। মাত্র কয়েক বছরে এটি লন্ডনের মূলধারার কবি, লেখক ও শিল্পরসিক দর্শকদের মধ্যে যে ইতিবাচক অভিঘাত তৈরি করেছে, তা আশ্চর্যজনক। এ বছর অনুষ্ঠানের দুদিন আগেই হলের সব আসন বুকড হয়ে যায়। সামনের বছরগুলোতে এটি আরও বর্ধিত আকারে অন্তত বৃটেনের অন্যান্য শহরেও প্রসারের পরিকল্পনা চলছে।
উৎসবের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন আলোকচিত্রী পাবলো খালেদ, তবলাবাদক কুন্তল দাস ও কবি সৈয়দ আনোয়ার রেজা।