রাজবংশী রায় ও জামশেদ নাজিম
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩ ০৮:৪২ এএম
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৩ ২১:৫৮ পিএম
আরাভ খান। ছবি সংগৃহীত
দুবাইয়ে হাজার কোটি টাকা মূল্যের জুয়েলারি শপ খুলে সবাইকে চমকে দিয়েছেন ৩০ বছর বয়সি আরাভ খান। দুবাইয়ের বিলাসবহুল নিউ গোল্ড সুক এলাকায়। বুধবার (১৫মার্চ) বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় জমকালো উদ্বোধন হয় তার আলোচিত এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের। যেখানে উপস্থিত ছিলেন তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।
প্রতিদিনের বাংলাদেশ গত বুধবার তাকে নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে পুলিশ হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন কীভাবে আরাভ খান হলেন, কীভাবে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে বিয়ে এবং দুবাইয়ে বিশাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তা সবিস্তারে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আরাভ খান আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। অনেকেরই প্রশ্ন- এই বয়সে কীভাবে তিনি এত বিত্তবৈভবের মালিক হলেন?
বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের হিরণ ইউনিয়নে জন্ম নেওয়া রবিউলের বিদেশে চাকচিক্যময় জীবনযাপনে এলাকার মানুষও বিস্মিত। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদিনের বাংলাদেশ তাকে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। এতে দেখা যায়, কখনও তিনি চার্টার্ড বিমানে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কখনও বুর্জ খলিফা এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনে তার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করছেন। কখনও দামি জার্মান ওডি গাড়ি বা বিএমডব্লিউ মোটরবাইকের ছবি প্রকাশ করছেন। কখনও হাঁসের ছবি প্রকাশ করে বলছেন, শেখের বাড়ির এই অতিথি এখন তার বাসায়ও দেখা যাবে।
আবার কখনও তিনি ক্যাসিনোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দুবাইয়ের বাড়িতে মায়াহরিণ জবাই করে শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়মিত দাওয়াত খাওয়াচ্ছেন। এ নিয়ে তিনি নিয়মিত ফেসবুক লাইভও করছেন। জুয়েলারি শপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়া হিরো আলম গত মঙ্গলবার দুবাইয়ে পৌঁছেই তার বাসার সুইমিংপুলে নামেন। সেই ছবি মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: কার ডাকে দুবাইয়ে সাকিব আল হাসান
দুবাই ও বাংলাদেশের একাধিক সূত্র বলছে, অপরাধজগতের একটি বড় গ্রুপের সঙ্গে রবিউলের সখ্য রয়েছে। একই সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালানকারী একটি চক্র, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কয়েকজন কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের একটি মহলের সঙ্গে তার এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার চক্রের সঙ্গেও সম্পর্ক রয়েছে রবিউলের। ঘনিষ্ঠরা তাদের পাচার করা অবৈধ টাকা রবিউলের কাছে গচ্ছিত রাখতে পারেন অথবা পরোক্ষভাবে তার ব্যবসার অংশীদার হতে পারেন বলেও কয়েকজন জানিয়েছেন।
বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, এমন কোনো অপকর্ম নেই যা রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান করেননি। তবে মূলত তরুণীদের দিয়ে ধনী ব্যক্তিদের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করা ছিল তার পেশা। এভাবেই আপন ওরফে আরাভ বড় অঙ্কের টাকা বানায়। পাশাপাশি সরকারি কিছু কর্মকর্তার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে তার। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও নানা তদবিরে ছাড়া পেয়ে যেতেন। এভাবে দিন দিন তার দাপট বাড়তে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি সূত্র জানায়, ব্ল্যাকমেইলের কাজে ব্যবহার করার জন্য আপন একাধিক বিয়েও করেছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যা মামলার অন্যতম আসামি কেয়াও তার একজন স্ত্রী ছিল।
আরাভ খান নামের ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখা যায়, ২০২০ সালে ২০ জানুয়ারি একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘দুবাইয়ের বুকে বুর্জ খলিফার ৬৫ তলা। ফ্ল্যাট নম্বর ৬৫১০। ফুল ফাউন্টেন ভিউর একটা ফ্ল্যাটের মালিক হলাম। আলহামদুলিল্লাহ। মানুষের ওপর ভরসা না করে নিজের প্রতি এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই কামিয়াবির লক্ষণ।’ দুবাইয়ের সংশ্লিষ্ট এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুর্জ খলিফা এলাকায় ৪ থেকে ৫ বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটের মূল্য ২ কোটি ৭ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৫০ কোটি টাকার বেশি। এক দিন ভাড়া থাকতে হলে গুনতে হবে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। পোস্টের ভিডিওতে পুরো ফ্ল্যাট দেখানো হয়েছে।
২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, দুবাইয়ের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট পেয়ে গেলাম। চেষ্টা করলে আল্লাহর রহমতে সবকিছুই সম্ভব।’ একই বছরের ২৭ আগস্ট ফেসবুকে শেয়ার করা অপর একটি ভিডিও পোস্টে দেখা যায়, একটি বিমান থেকে তিনি নামছেন। সেখানে লিখেছেন, ‘প্রাইভেট বিমানে ঘোরার মজাটাই আলাদা।’ চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি একটি বাজপাখির ছবি শেয়ার করে তিনি লিখেছেন, আমার বাসার নিউ মেম্বার। যেটা শুধু দুবাইয়ের শেখদের বাসায় দেখেছি। এখন ইনশাল্লাহ আমার বাসায় থাকবে।’
দুবাইয়ের একজন বাসিন্দা জানান, বাজপাখি দুবাইয়ের শেখদের অত্যন্ত প্রিয়। তাদের সবার বাসায় এই পাখি পোষা হয়। এটিকে তারা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেন। এসব পাখির পরিচর্যার জন্য বেতনভুক কর্মী নিয়োগ করা হয়। এই পাখির নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ চিকিৎসার জন্য পৃথক হাসপাতালও রয়েছে। শেখদের বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ এই বাজপাখি পোষে না। একেকটি পাখির দাম ৯০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটিরও বেশি।
চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ফেসবুক লাইভে এসে আরাভ খান (রবিউল) বলেছেন, ‘সরষে শাক লাগিয়েছি। মুলা শাক, পুঁই শাক, লাল শাক, মরিচ চাষ করেছি ভিলাতে।’ সুরম্য দ্বিতল ভবনের সামনে মাছ চাষ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে লাইভ অ্যাকুয়ারিয়াম। অপরপাশে সুইমিংপুলের কাজ চলছে। বাঁদিকে বসার ঘর। ডানদিকে ছাউনিবেষ্টিত একটি অংশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা হয়। ভিডিও লাইভে রেঞ্জ রোভারসহ কয়েকটি দামি গাড়ি পার্ক করা অবস্থায় দেখা যায়।
এলাকায় নানা আলোচনা
গোপালগঞ্জ প্রতিবেদক জানান, প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘কার ডাকে দুবাইয়ে সাকিব আল হাসান’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর গোপালগঞ্জে হইচই পড়ে যায়। সর্বত্র এই আলোচনা চলছে, রবিউল কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন?
রবিউলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার আশুতিয়ায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, রয়েছে টিনশেডের একটি ঘর। দরজায় তালা ঝুলছে। খোঁজ করেও পাওয়া গেল না রবিউলের কোনো আত্মীয়-স্বজনকে। তবে পাওয়া গেল গ্রামের দুয়েকজনকে। তাদের সঙ্গে কথা হলেও রবিউলকে সেভাবে চেনেন না গ্রামের অধিকাংশ মানুষ।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আতীয়ার রহমান মোল্লা বলেন, ‘পত্রিকায় তাকে নিয়ে যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে তা পড়ার পর তাদের নিয়ে কথা বলাটা বিব্রতকর। রবিউলের বাবা মতিউর মোল্লা একসময় খুলনায় ফেরি করতেন। জীবিকার প্রয়োজনে তিনি কোটালীপাড়ায় চলে আসেন। এরপর কৃষিকাজ ও মাছ ধরাই ছিল মূলত তার পেশা। পরে এখানে তিনি জমি কিনে বাড়ি করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় রবিউল। লেখাপড়ায় সে ছিল অমনোযোগী। যতদূর জানি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। এরপরই জড়িয়ে পড়ে নানা অপকর্মে। পরে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেটাও ১৮-১৯ বছর আগে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বাড়িতে রবিউলের স্ত্রী-সন্তান শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতেন। তবে কয়েক মাস হলো বাড়িতে তাদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত তারা বিদেশে চলে গেছেন।’
হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাইফুদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘হঠাৎ করে আমরা জানতে পেরেছি সে কোটি কোটি টাকার মালিক। দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান রয়েছে। কিন্তু তার পরিবারের যে অবস্থা... এত অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক হওয়া সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, অবৈধ পথেই এই টাকা তিনি আয় করেছেন। এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।’
হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজাহারুল আলম পান্না বলেন, ‘প্রায় এক যুগ আগে আপন একবার বাড়ি এসেছিল। এরপর তাকে গ্রামে আর দেখা যায়নি। তাই তার সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানতাম না। তবে প্রতিদিনের বাংলাদেশ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।’
পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রবিউল রহস্যজনকভাবে দেশ থেকে পালানোর সুযোগ পায়। এরপর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করতে অন্তত ১২ বার পরোয়ানা জারি করেন আদালত। কিন্তু তাকে খুঁজে পায়নি পুলিশ।
২০১৮ সালের ৭ জুলাই রহমতুল্লাহ নামের একজনের আমন্ত্রণ পেয়ে পুলিশ পরিদর্শক মামুন বনানীর একটি বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যান। পরে পুলিশের তদন্তে দেখা যায়, মামুন ফাঁদে পড়েছিলেন। তাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে বেঁধে, স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে গাজীপুরের জঙ্গলে নিয়ে পেট্রল ঢেলে মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ওই হত্যা মামলার আসামিরা হলেনÑ রহমত উল্লাহ, রবিউল ইসলাম, তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া, স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সারোয়ার হোসেন, মেহেরুন্নিসা ওরফে স্বর্ণা ও ফারিয়া বিনতে মাইসা। এদের বেশিরভাগই এখন জামিনে অথবা পলাতক।
ইন্টারপোলের দ্বারস্থ পুলিশ
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতে সোপর্দ করার চেষ্টা চলছে। এজন্য কাজ শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)।
পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে আরাভকে বাংলাদেশে আনার প্রক্রিয়া দ্রুতই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা।