মেরিনা লাভলী, রংপুর
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০০:৩২ এএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১০:৪৬ এএম
ঈদ শুভেচ্ছা কুশল বিনিময়ে জি এম কাদের ও মসিউর রহমান রাঙ্গা। ছবি : সংগৃহীত
মসিউর রহমান রাঙ্গা। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত-সমালোচিত নাম। বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির টানা ৩ বারের সভাপতি তিনি। সাবেক প্রতিমন্ত্রী, এমপি ও জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও আস্থাভাজন। জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পত্নী রওশন এরশাদের পাতানো ভাগিনা তিনি। প্রচলিত আছে, রওশনকে ব্যবহার করেই রাঙ্গা দলের মাঝে প্রভাব বিস্তার করতেন। জাতীয় পার্টির দুর্গ খ্যাত রংপুরেও ছিল তার শক্ত প্রভাব। রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ সময়।
তবে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার পদ নিয়ে ২০২২ সালে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। তখন রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে সমর্থন দেওয়ায় জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন মসিউর রহমান রাঙ্গা। বিক্ষুব্ধ রাঙ্গা ঘোষণা দেন জিএম কাদেরকে জুতাপেটাসহ আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপের। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ রংপুরের স্থানীয় নেতারা। সেই সময় জিএম কাদের ও রাঙ্গার কর্মী-সমর্থকরা একপক্ষ আরেকপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও কুশপুত্তলিকা দাহ করে। রংপুরে জিএম কাদের ও রাঙ্গা উভয়কেই ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে প্রতিপক্ষের কর্মী-সমর্থকরা। এ নিয়ে চরম উত্তেজনা চলে দীর্ঘ সময়। দলের পদ হারিয়ে নিজ জেলায় কোণঠাসা হয়ে পড়েন রাঙ্গা।
এরই মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। দলের সঙ্গে দূরত্ব ঘুচিয়ে রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও আংশিক সিটি করপোরেশন) আসনে মনোনয়ন নিয়ে রাঙ্গা দলে সক্রিয় হবেন, এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই আসনে জিএম কাদেরের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। লাঙ্গল প্রতীক হারিয়ে রাঙ্গা ট্রাক মার্কা নিয়ে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়ান। কিন্তু ৭ জানুয়ারির ওই সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান বাবলুর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন পরপর দু’বারের এমপি হেভিওয়েট প্রার্থী মসিউর রহমান রাঙ্গা। রাজনীতিবিদদের মতে, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন রাঙ্গা।
জাতীয় নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা রওশনকে চেয়ারম্যান করে দল গঠন করেন। কিন্তু এতে অংশ নেয়নি মশিউর রহমান রাঙ্গা। তবে সম্প্রতি জাতীয় পার্টিতে সম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন মশিউর রহমান রাঙ্গা। ঈদুল ফিতরের পরদিন শুক্রবার (১২ এপ্রিল) রংপুর নগরীর সেনপাড়ায় স্কাইভিউ বাসভবনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। পা ছুঁয়ে সালাম করার পাশাপাশি কুশল বিনিময় করেন। জিএম কাদের ও রাঙ্গার কয়েকটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরালও হয়। জাতীয় পার্টিতে রাঙ্গার এই ফিরে আসা নিয়ে রংপুরে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। তবে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের পরিষ্কার করে দিয়েছেন, সহসাই দলে ফিরতে পারছেন না রাঙ্গা। নীতিনির্ধারক নেতাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই রাঙ্গার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। দলে রাঙ্গাকে ফিরিয়ে নিলে জাপার লাভ-ক্ষতির মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এবং এই মূল্যায়নের ভিত্তিতেই তেমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘জিএম কাদের শুধু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানই নন, তার সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্কও রয়েছে। আমি তার সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমাও চেয়েছি। তিনি যেহেতু আমাকে বহিষ্কার করেছেন, নিশ্চয়ই তিনি আমার কোনো দোষ দেখেছেন। আমি তাকে বলেছি, দল এককভাবে চালানো যায় না। সবাইকে মিলে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। দলের জন্য কেউ ক্ষতিকারক না, সবাই দলের জন্য কাজ করে। তবে কোনো কোনো কারণে কাউকে দূরে, কাউকে আবার কাছে রাখতে হয়। দলের চেয়ারম্যান আমার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন।’
তিনি বলেন, ‘জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি হচ্ছে মূল দল। আমি সেই দলের মহাসচিব ছিলাম। রওশন এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে আমি নেই। আমার বর্তমান পরিচয়, আমি পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি। দলের জন্য যারা ত্যাগ করেছেন, নিজের জীবনের ক্ষতি করেছেন, সম্পদ নষ্ট করেছেন তাদের দলে থাকা দরকার ও উচিত বলে আমি মনে করি ‘
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘মশিউর রহমান রাঙ্গা রংপুরে এসে ঈদ উদযাপন করেছেন, পাশাপাশি চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেছেন। চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার কুশল বিনিময়সহ রাজনৈতিক আলাপ হয়েছে। তবে রাঙ্গাকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে দলের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘মশিউর রহমান রাঙ্গা আমার বাড়িতে এসে তার ভুল স্বীকার করেছেন। আমি মুরব্বি হিসেবে যেন তার ভুল ক্ষমা করে দেই, সেই অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, তাহলে তার মনের ভেতর থেকে অপরাধবোধ কেটে যাবে। পরে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে সুযোগ পেলে ফিরে আসবেন বলেও জানিয়েছেন। আমি তাকে বলেছি, আমি তো এককভাবে দল পরিচালনা করি না। আলোচনার ভিত্তিতে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাঙ্গার দলে ফেরা, না ফেরার বিষয়টি নির্ধারণ হবে। তিনি জাতীয় পার্টিতে ফিরে এলে দলের কতটুকু ভালো হবে, মন্দ হবে সেসব বিষয় বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা কাউকে হঠাৎ করে ফেলে দিতে চাই না, আবার হঠাৎ করে কাউকে নিতেও চাই না।’