ফয়সাল খান
প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:০৮ এএম
আপডেট : ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:২৪ এএম
ফাইল ছবি
রাজধানীর উপকণ্ঠে গাজীপুরের ৫টি আসনেই প্রার্থী দেয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। এরই মধ্যে ৩টি আসন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন প্রার্থীরা। বাকি দুইটি আসনে সরে যাওয়ার ঘোষণা না দিলেও তেমন কোনো প্রচার নেই বলে জানিয়েছেন দলটির স্থানীয় নেতারা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া ২৬ আসনসহ ৩৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার সক্ষমতা রয়েছে জাপার। তা ছাড়া বাকি আসনগুলোর অবস্থা প্রায় গাজীপুরের মতোই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দুই শতাধিক আসনেই ভোটের মাঠে ‘সক্রিয়’ নেই জাপা প্রার্থীরা। এসব আসনে জামানত হারানোর শঙ্কা থেকে এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক প্রার্থী নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। নীরবে ভোটের মাঠ থেকে দূরে রয়েছেন জাপার আরও কিছু প্রার্থী।
গাজীপুরের ৫টি আসনের মধ্যে জাপার সবচেয়ে ভালো প্রার্থী ছিলেন এম এম নিয়াজ উদ্দিন। তিনি গাজীপুর-১ ও ৫ আসনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন। সরকারের সাবেক এই সচিব গত বছর মে মাসে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও মেয়র পদে জাপার প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনে তিনি ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট পেয়ে প্রার্থীদের মধ্যে পঞ্চম হন। এমনকি তুলনামূলক ‘অপরিচিত দল’ গণফ্রন্টের প্রার্থীর চেয়েও কম ভোট পেয়ে জামানত হারান। এমন বাস্তবতায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েও সরে দাঁড়িয়েছেন বলে স্থানীয়দের মধ্যে আলোচনা চলছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এম এন নিয়াজ উদ্দিন বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনা করে ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দলের উচ্চপর্যায়ের কারও সঙ্গে আলোচনা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩০ থেকে ৩৫টি আসন ছাড়া বাকি আসনগুলোতে জাপার প্রার্থীরা ভরাডুবির আশঙ্কা করছেন। এমনকি প্রার্থীদের জামানতও বাজেয়াপ্ত হতে পারে। এমন আশঙ্কা থেকেই প্রার্থীরা সরে যাচ্ছেন। এক প্রার্থীর ভাষ্য, ‘নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মান-ইজ্জত হারাতে পারব না।’
নির্বাচন ছেড়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে প্রার্থীরা বলছেন, জাতীয় পার্টির শীর্ষ তিন নেতা আসন ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছেন। ২৬ আসন ছাড়া যারা নির্বাচন করছেন তারা সাবাই জানেন ফলাফল কী হবে। কেন্দ্র থেকে সব প্রার্থীকে আর্থিক সহায়তা করার কথা বলা হলেও এখন কেউ কারও কোনো খোঁজ নিচ্ছেন না। কোনো সিদ্ধান্তও জানতে পারছেন না প্রার্থীরা।
ঢাকার ১০ আসনে ভরাডুবির আশঙ্কা
ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ৪টি আসনে জোর প্রচার চালিয়েছেন জাপা প্রার্থীরা। আর ৬টি আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বাকি ১০টি আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই ১০টি আসনে তেমন প্রচারও চালাননি দলটির প্রার্থীরা।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া ঢাকা-১৮ আসনে পার্টির চেয়ারম্যানের স্ত্রী শেরিফা কাদের বেশ জোরেশোরে প্রচার চালিয়েছেন। তবে তাকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র দুই শক্ত প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। তা ছাড়া ঢাকা-১, ঢাকা-৪ ও ঢাকা-৭ আসনে প্রতিদিনই লাঙ্গলের প্রচার চালিয়েছেন অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও হাজী মিলন।
ঢাকা-১০ আসনের ধানমন্ডির কয়েকটি সড়কে লাঙ্গলের কিছু পোস্টার দেখা গেলেও প্রার্থীকেই চেনেন না অনেক ভোটার। কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা আসাদুল্লাহ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, এই আসনে নৌকার প্রার্থী চিত্রনায়ক ফেরদৌস ছাড়া আর তেমন কোনো প্রার্থী নেই। লাঙ্গলের কোনো মাইকিং বা প্রচারও দেখেননি তিনি। ঢাকা-১২, ঢাকা-৮, ঢাকা-৯ ও ঢাকা-১১ আসনেও প্রায় একই রকম চিত্র দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, সুষ্ঠু ভোট হলে ঢাকার ৪টি আসন ছাড়া অন্য সব আসনে জামানত হারাতে পারেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। ঢাকা-৫, ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, ঢাকা-১৪, ঢাকা-১৭ ও ঢাকা-১৯ আসনে এরই মধ্যে জাপা প্রার্থীরা মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
ঢাকা-১১ আসনের জাপা প্রার্থী শামীম আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে দাবি করেন, ‘আমরা মাঠে আছি, প্রচারও চালিয়েছি। আমরাই প্রকৃত জাতীয় পার্টির প্রার্থী। কারণ আমরা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করিনি। তাই মানুষ আমাদের ভোট দেবে।’
ঢাকা-৭ আসনের প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন জানান, তার জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নানাভাবে হুমকিধমকি দিচ্ছে। নির্বাচনের দিন তার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
৩৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস
জাপার সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬ আসন ছাড় পেলেও সবগুলোতে দলীয় প্রার্থী সহজে জয় পাবে না। ১০ থেকে ১৫টি আসনে জয় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এসব আসনেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখমোখি হতে হবে জাপা প্রার্থীদের। সব মিলিয়ে ৩৯টি আসনে জাপার প্রার্থীরা বেশ শক্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নৌকার সঙ্গে লাঙ্গলের লড়াই ১৩ আসনে
ছাড় না পাওয়া ঢাকা-১ আসনে অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, ঢাকা-৪ আসনে সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি ও ঢাকা-৭ আসনে হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, রংপুর-২ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য আনিছুল ইসলাম মণ্ডল, রংপুর-৪ আসনে মোস্তফা সেলিম বেঙ্গল, রংপুর-২ আসনে আনিছুর রহমান, সিলেট-২ আসনে ইয়াহিয়া চৌধুরী এবং সিলেট-৩ আসনে জাপার প্রার্থী মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বেশ জোরেশোরেই ভোটের মাঠে আছেন।
নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে লিয়াকত হোসেন খোকা, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে পীর ফজলুর রহমান ও বরিশাল-৬ আসনে নাসরিন হাওলাদার রত্না বেশ শক্তভাবে মাঠে রয়েছেন। রওশন এরশাদের ময়মনসিংহ-৪ আসনে জাপার প্রার্থী আবু মুসা সরকার এবং জি এম কাদেরের লালমনিরহাট-৩ আসনে লাঙ্গলের জাহিদ হাসান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। এসব আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার আশা করছেন জাপা নেতারা।
জাপার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির ২৬ প্রার্থীসহ ২৮৩ আসনে জাপার দলীয় প্রার্থী ছিল। দলটির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৩২ জন প্রার্থী ভোটের মাঠ ছাড়ার দাবি করলেও এই সংখ্যা অর্ধশতাধিক বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী রাকিব হোসেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রহসনের নির্বাচন হচ্ছে। ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই।’
রাকিব হোসেন বলেন, ‘লক্ষ্মীপুরের সাধারণ মানুষ নির্বাচন থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছে। শুধু বিশেষ সুবিধাভোগী কিছু লোক নির্বাচনের মাঠ গরম রেখেছে।’ গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী-৬ আসনের প্রার্থী ও জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মো. শামসুদ্দিন রিন্টু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।
জাপার প্রার্থীদের সরে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার রংপুরে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ১৯৯০-এর পর থেকে যখনই ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়েছি, তখনই অনেক প্রার্থী সরে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই অভিজ্ঞতা নিতে আসে, পরিচিত হতে আসে। ১৯৯০ সালের পর থেকে ৩০০ আসনে নির্বাচন করার যোগ্যতা জাতীয় পার্টির কখনই ছিল না।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে জাপা অনেক জায়গায় বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের ভোটার-কর্মীদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে তাদের আইনের আশ্রয় নিতে বলছি এবং তারা আইনি সহায়তা নিচ্ছেন।’