বগুড়া-৬ আসন
বগুড়া অফিস
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৩ ১২:৫৮ পিএম
আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৩ ২০:০৮ পিএম
খালেদা জিয়া। ফাইল ফটো
বগুড়ার ৭টি সংসদীয় আসনের মধ্যে রাজনৈতিক কারণে বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৭ (গাবতলী ও শাজাহানপুর) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি চেয়ারপারসন একাধিকবার এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় আসন দুটি পরিচিত ‘খালেদা জিয়ার আসন’ হিসেবে। ২০০১ সালে বগুড়া-৬ আসনে সারা দেশের মধ্যে সর্বাধিক ভোট পেয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন খালেদা জিয়া। তবে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার পর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে না পারায় আসন দুটি ঘিরে বদলে গেছে বিএনপির সমীকরণ।
অবশ্য আগামী নির্বাচন ঘিরে এখনও বিএনপির সম্ভাব্য কোনো প্রার্থীর প্রকাশ্য কোনো তৎপরতা নেই এই দুটি আসনে। দলটির নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে তারা অটল। তাই প্রার্থিতার বিষয় নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাচ্ছেন না তারা। তবে আন্দোলনের মাধ্যমে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা যায় তাহলে এই দুই আসনে খালেদা জিয়া কিংবা তার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান প্রার্থী হবেন বলে আশা দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। তবে তারা অংশ নিতে না পারলে এবং শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে গেলে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে কয়েকজনের নাম আলোচনায় আছে।
অন্যদিকে এই দুটি আসন ঘিরে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা আগেভাগেই ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করেছেন। এর মধ্যে বগুড়া-৬ আসন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে বেশি। কারণ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৫০ বছর পর আসনটি নৌকার দখলে এসেছে। আলোচিত দুই আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন আওয়ামী লীগের অন্তত পাঁচ নেতা। এ ছাড়া দুটি আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও। তবে বগুড়া-৬ আসনের ভোটারদের মধ্যে বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য প্রার্থীর তৎপরতা।
একটি পৌরসভা এবং সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বগুড়া-৬ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ১০ হাজার ৭৩৪ জন। ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এই আসনে বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়েছেন খালেদা জিয়া। কিন্তু আইনি জটিলতায় ২০১৮ সালে তিনি প্রার্থী হতে না পারায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ আসনে প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হলেও তিনি শপথ না নেওয়ায় পরে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আগামী নির্বাচনে যদি খালেদা জিয়া প্রার্থী হতে না পারেন এবং তারেক রহমানও যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না পান, তাহলে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা ও সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। যদিও নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত তাদের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
জানতে চাইলে রেজাউল করিম বাদশা বলেন, নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পরই কেবল তারা নির্বাচনের কথা ভাববেন। তবে বিএনপির এই নেতার মতে, বগুড়ার মানুষ বিএনপি ভক্ত। ভোট সুষ্ঠু হলে অতীতে এখানকার মানুষ বিএনপির পক্ষে ভোট বিপ্লব করেছে, আগামীতেও করবে।
অন্যদিকে আসনটি দখলে রাখতে মরিয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আগামী নির্বাচনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে তৎপরতা চালাচ্ছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু, সহসভাপতি টি জামান নিকেতা, সহসভাপতি ও বগুড়া পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম মন্টু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন এবং তার স্ত্রী কোহিনূর মোহন।
আগামী নির্বাচন মাথায় রেখে রাগেবুল আহসান রিপু বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়েছেন। অন্যরা দলীয় কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনী রাজনীতিতে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে রিপু বলেন, ‘বগুড়ার মানুষকে এতদিন ভুল বুঝিয়ে আওয়ামী লীগ তথা নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছিল। কিন্তু জনগণ এখন তাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। যে কারণে ৫০ বছর পর এই আসনে নৌকা আবারও বিজয়ী হয়েছে। ইনশাআল্লাহ্ আগামী নির্বাচনেও নৌকা জয়ী হবে।’
আসনটিতে জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম ওমরের নাম। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। পরে ২০১৯ ও ২০২৩ সালের উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়েও জিততে পারেননি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে নূরুল ইসলাম ওমরের কোনো তৎপরতা চোখে না পড়লেও বগুড়ায় জাতীয় পার্টির নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাড়িয়ে নেতাকর্মীদের তার পক্ষে সংগঠিত করছেন।
নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর বলেন, ‘দলীয়ভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি আমাদের আছে। আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি এবং ভালো সাড়াও পাচ্ছি।’
বগুড়া-৬ আসনে নির্বাচনকে ঘিরে অন্য সব দলের চেয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তুতি চোখে পড়ার মতো। দলটি এরই মধ্যে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে এবং বিভিন্ন কৌশলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে আগাম প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেছে। দলের বগুড়া শহর শাখার আমির আবিদুর রহমান সোহেলের পক্ষে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা বাণী সংবলিত শত শত পোস্টার বগুড়া শহরের অলিগলি এবং গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারেও সাঁটানো হয়েছে। তার প্রার্থিতার কথা জানান দিয়ে স্থানীয় পত্রিকাগুলোতেও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়ার জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরাও ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন।
জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়, নিবন্ধন কিংবা দলীয় প্রতীক ফিরে না পেলে স্বতন্ত্রভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জামায়াত নেতা আবিদুর রহমান সোহেল জানিয়েছেন, প্রার্থী চূড়ান্ত করা হলেও বর্তমান সরকারের অধীনে জামায়াতে ইসলামী কোনো নির্বাচনে যাবে না।
তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই আমরা অংশগ্রহণ করব।’
বগুড়া-৭ : গাবতলী ও শাজাহানপুর নামে দুটি উপজেলার একটি পৌরসভা এবং ২০ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বগুড়া-৭ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ৪১ হাজার। ২০০১ পর্যন্ত গাবতলী উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন এবং তৎকালীন বগুড়া সদর উপজেলার (বর্তমানে শাজাহানপুর উপজেলা) ৩টি ইউনিয়ন বগুড়া-৭ আসনের আওতাভুক্ত ছিল। তবে ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে বগুড়া-৭ আসন পুনর্গঠন করা হয়। তখন গাবতলী উপজেলার একটি পৌরসভা, ১১টি ইউনিয়ন এবং ২০০৫ সালে বগুড়া সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত শাজাহানপুর উপজেলা এলাকাকে বগুড়া-৭ আসনের অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান গাবতলী বগুড়া-৭ আসনের আওতাভুক্ত হওয়ায় এখানে তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া সেই ১৯৯১ সাল থেকেই প্রার্থী হয়েছেন। তবে দলীয়ভাবে ভোট বর্জনের কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হননি। আর দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থীই হতে পারেননি।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়া ও তারেক অংশ নিতে না পারলে বিকল্প হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক সংসদ সদস্য হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু ও গাবতলী উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোর্শেদ মিল্টন মনোনয়ন চাইতে পারেন। এরই মধ্যে মোর্শেদ মিল্টন বগুড়ার গাবতলী উপজেলার গ্রামাঞ্চলে নেতাকর্মীদের নিয়ে একাধিকবার মোটরসাইকেল র্যালি করে নিজের নির্বাচনী তৎপরতার কথা পরোক্ষভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।
বিএনপির ঘর হিসেবে পরিচিত এই আসনে আওয়ামী লীগের ৩ নেতা মনোনয়ন পেতে ইচ্ছুক। তাদের মধ্যে ২০০৮ সালের উপনির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি ডা. মোস্তফা আলম নাননু আবারও নৌকার কাণ্ডারি হওয়ার ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী। তবে গাবতলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রফি নেওয়াজ খান রবিন এবং বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুর রহমান দুলুও মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
ডা. মোস্তফা আলম নাননু জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাকে যদি আর একবার সুযোগ দেওয়া হয় অর্থাৎ মনোনয়ন দেওয়া হয় তাহলে আসনটি আমি নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে পারব ইনশাআল্লাহ্।
আসনটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আলতাফ হোসেন এবং জাতীয় পার্টির (জেপি) একক প্রার্থী হিসেবে বগুড়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম পিন্টুর নাম আলোচনায় রয়েছে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বর্তমান সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু আবারও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা জানিয়েছেন।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘বগুড়া-৭ আসনে অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্যই নির্বাচনে অংশ নিতে চাই।’