রাহাত হুসাইন
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫ ০৯:১৫ এএম
আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫ ০৯:১৬ এএম
জাতীয় পার্টির (জাপা) আসন্ন দশম জাতীয় সম্মেলনকে ঘিরে ফের চরম দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। দুপক্ষের টানাপড়েনে ফের ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে এইচএম এরশাদের দলটি। জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্ব নিয়ে এ বিরোধ বেড়েছে। দলটির চেয়ারম্যান সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করলেও সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এ সিদ্ধান্তকে ‘অগণতান্ত্রিক ও একক’ বলে আখ্যা দিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা ২৮ জুনেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের উন্মুক্ত স্থানে জাতীয় সম্মেলন করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
গতকাল মঙ্গলবার এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই চেয়ারম্যান গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা গঠনতন্ত্র ও দলীয় শৃঙ্খলার পরিপন্থি। এককভাবে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া দলীয় গঠনতন্ত্র, প্রেসিডিয়ামের সম্মান এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি। আমরা এই সিদ্ধান্তে বিস্মিত ও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’
অন্যদিকে পূর্বনির্ধারিত দিনে সম্মেলন স্থগিত করার বিষয়ে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, সম্মেলনের জন্য নির্ধারিত বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ বাতিল করেছে। কারণ ওই দিনে বাজেট-সংক্রান্ত একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। তাই ‘হল বরাদ্দ সাপেক্ষে’ নতুন তারিখ পরে জানানো হবে।
সম্মেলনকে ঘিরে জাপার শীর্ষ নেতৃত্বের বিভক্তি আবারও প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। দুই পক্ষের সুর এতটাই ভিন্নমুখী যে, জাপার মধ্যে একটি ‘ডুয়েল কমান্ড’ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একদিকে দলের মূল চেয়ার ধরে রাখার চেষ্টা, অন্যদিকে দলের ভেতর থেকে কাদেরকে বাদ দিয়ে নতুন করে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের তোড়জোড়।
গত ২০ মে অনুষ্ঠিত জাপা প্রেসিডিয়াম সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রয়োজনে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই সম্মেলন হবে। কিন্তু চেয়ারম্যান সে সিদ্ধান্ত এড়িয়ে গিয়ে সম্মেলন স্থগিত করায় প্রবল অসন্তোষ বিরাজ করছে দলটির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে।
জানা গেছে, এই সম্মেলন ঘিরেই জাপায় বড় একটি মাইনাস প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জিএম কাদেরকে বাদ দিয়েই দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন দলের একাধিক সিনিয়র নেতা। নেতৃত্ব নিয়ে মতপার্থক্য থেকে ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছেÑ এটি কেবল হলের সংকট নয়, বরং নেতৃত্ব সংকটের বহিঃপ্রকাশ। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চেয়ারম্যান এবং এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব হিসেবে একটি প্যানেল দাঁড় করালে জিএম কাদের অসন্তুষ্ট হয়ে সম্মেলনের গতি থামানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে সিনিয়র নেতারা ‘কাদেরবিহীন জাপা’ গড়ার উদ্যোগে নেমেছেন। এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছেন সাবেক কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ অনেকেই, যারা একসময় কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সূত্র জানায়, দেশের অধিকাংশ জেলাতেই তৃণমূল পর্যায় থেকে এই নতুন নেতৃত্বকে সমর্থন জানানো হচ্ছে।
জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘গঠনতন্ত্রে এমন ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যাতে চেয়ারম্যান যাকে খুশি বহিষ্কার করতে পারেনÑ এটা কোনো গণতন্ত্র নয়। এজন্য তাকে কোনো জবাবদিহিও করতে হয় না। আমি এই ধারার বিপক্ষে সব সময়ই বলে আসছি।
এ বিষয়ে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা আল মাহমুদ বলেন, ‘চেয়ারম্যান এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন, প্রেসিডিয়ামের মত উপেক্ষা করেন। দলটি গণতন্ত্রমুখী হোক, প্রেসিডিয়াম সভায় যে সিদ্ধান্ত হবে সেটিই বাস্তবায়ন করতে হবে, কোনোভাবেই একক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। তবে রংপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা জিএম কাদেরের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, ‘যারা এখন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তারাই আসলে আওয়ামী লীগ ঘেঁষা। তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের দালালি করেছেন।’
জাপার ইতিহাসে এটি সপ্তম দফা বড় ধরনের ভাঙনের আভাস। নব্বইয়ের পর হুদা-মতিন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, কাজী জাফর, নাজিউর রহমান, রওশন এরশাদÑ প্রতিবারই দল ভেঙেছে। ২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর জিএম কাদের চেয়ারম্যান হন। ২০২৪ সালের নেতৃত্ব দ্বন্দ্বের জের এখন আরও স্পষ্ট।
বিশ্লেষকদের মতে, ২৮ জুনের সম্মেলন শুধু নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্যই নয়, বরং নির্বাচন কমিশনের আরপিও অনুযায়ী দলীয় বৈধতা বজায় রাখার দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মেলন স্থগিত থাকলে জাপা একটি বড় সাংগঠনিক ও আইনি সংকটে পড়বে।