গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে নেতৃত্ব দেবে যুবদল

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সারা দেশে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন যুবদলের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে অস্বীকার করছেন না সংগঠনটির সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না। তবে যুবদলের নাম ভাঙিয়ে অন্যরাও অপকর্ম করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপপ্রচারও হচ্ছে। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় সারা দেশে নেতাকর্মীদের মনিটরিংয়ে রাখা হয়েছে। অসংগতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ দেশের জনগণ বিএনপিকে আস্থার জায়গায় রেখেছে বলেও দাবি করেন যুবদলের সভাপতি।

সম্প্রতি চলমান রাজনীতি, নির্বাচন, যুবসমাজ নিয়ে চিন্তা ও আগামীর বাংলাদেশসহ সাম্প্রতিক নানা ইস্যু নিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক মো. আকরাম হোসেন

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : যুবদলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

মোনায়েম মুন্না : ‘বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচন খুবই জরুরি। নির্বাচন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। নির্বাচিত সরকারের যে দায়বদ্ধতা থাকে, তা অন্য কোনো সরকারের থাকে না। সেই জায়গা থেকে যুবদলের আকাঙ্ক্ষা একটি গণতান্ত্রিক সরকার। এই গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে যুবদল নেতৃত্ব দেবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যুবসমাজ যে ভূমিকা রাখে, আগামী দিনে আমরা সেভাবেই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাব ইনশাল্লাহ।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তন এসেছে, আপনাদের মূল্যায়ন কী?

মোনায়েম মুন্না : ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করছেন। জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তার পথেই আছেন তারেক রহমান। সততা ও দেশপ্রেমের জায়গা থেকেই তার প্রমাণ রেখে চলেছেন। তিস্তার পানি ও ভারতীয় দূতাবাসে হামলার প্রতিবাদে আমরা তিস্তা অভিমুখে লংমার্চ করেছি। কিন্তু অন্য কোনো দল করতে পারেনি। সুতরাং আমরা জনগণের পাশে থেকেই আওয়াজ তুলছি এবং বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবছি। জিয়াউর রহমান বলেছিলেন ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, আর তারেক রহমান বলেছেন ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। তিনি বাংলাদেশকে ধারণ করছেন এবং আগামী দিনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন ইনশাল্লাহ।

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : যুবদলের নেতাকর্মীদের কিছু কাজ সমালোচিত হয়েছেÑ এটা এড়ানো যেত কি না?

মোনায়েম মুন্না : ‘দলের কোনো নেতাকর্মী অন্যায় করলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। কখনও অস্বীকার করছেন না। যুবদলের কেউ জড়িত থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদের সরাসরি জানাচ্ছেন এবং আমরা তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিছু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত কমিটির মাধ্যমেও তদন্ত করছি। সম্প্রতি গাজীপুরের জাহাঙ্গীর নামে যুবদলের এক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠলে আমরা তাকে বহিষ্কারের পাশাপাশি মামলাও করেছি। আমরা প্রত্যেক জায়গায় ব্যবস্থা নিচ্ছি। যুবদলের নেতাকর্মীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখছেন তারেক রহমান। আমি ৪০ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আমার জায়গা থেকে দলের দায়িত্ব পালনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : যুবদলের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কি না?

মোনায়েম মুন্না : ‘বিগত সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় অপপ্রচার চালিয়ে বির্তকিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিএনপির অনেক নেতার বিরুদ্ধে প্রোপ্রাগান্ডা রচনা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে মিডিয়া স্বীকার করেছে, তাদেরকে বিএনপির বিরুদ্ধে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছিল তা ছাপানো ভুল ছিল। বিশেষ করে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রচার করা নিউজগুলো মিথ্যা ছিল, আজকে প্রমাণিত হচ্ছে। আজকে আবারও বিএনপি ও যুবদলকে মিডিয়া ট্রায়ালের চেষ্টা করা হচ্ছে।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় জেলা-মহানগরে দলীয় নির্দেশনা দিয়েছেন কি না?

মোনায়েম মুন্না : ‘দপ্তর থেকে যুবদলের নেতাকর্মীদের মনিটরিং করা হচ্ছে। যেখানে সমস্যা দেখছি সেখানে সরাসরি আমি কথা বলছি। অনেক জায়গায় দেখেছি, মিডিয়া মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে। যুবদল করে না অথচ বলছে যুবদল কর্মী। দলের কর্মী পরিচয়ে কেউ অন্যায় করলে তো আমরা গ্রহণ করব না।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : যুবদলের নেতাকর্মীরা দলীয় কমান্ড মানছেন না কেন, কারণ কী?

মোনায়েম মুন্না : ‘মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ রয়েছে। এত বড় রাজনৈতিক দলে কিছু খারাপ মানুষ তো থাকতেই পারে। একটা পরিবারের মধ্যেও সবাই শতভাগ ভালো হয় না। তবে যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে তাদের কাউকে আমরা ছাড় দিচ্ছি না। তাৎক্ষণিক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসছি। আগে আওয়ামী লীগ সরকার অস্বীকার করেছে। তবে আমরা স্বীকার করছি। আমরা চেষ্টা করছি।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : বর্তমানে আপনাদের চাওয়া কী?

মোনায়েম মুন্না : ‘দেশের সর্বস্তরের মানুষের এই মুহূর্তে চাওয়াÑ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কে দেশ চালাবেনÑ এটা নির্ধারণ করবে জনগণ। বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। জনগণ বিএনপিকে আস্থার জায়গায় রেখেছে। আশা করি, জনগণের ভোটের মাধ্যমে বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অসীন হবে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মাধ্যমে মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশে উন্নিত করতে পারবেন।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : জেলা-মহানগরে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি হলেও যুবদলের কমিটি কেন হয় না?

মোনায়েম মুন্না : ‘আওয়ামী লীগের শাসনামলে অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে সম্মেলন করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তারপরও আমরা ভোটাভুটির মাধ্যমে লালমনিরহাট, সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি গঠন করেছি। আজকে আবার গণতন্ত্র উত্তরণে আরেক ধরনের বাধা আসছে। আগে উন্নয়ন উন্নয়ন বলত, আর তারাই এখন বলছে সংস্কার সংস্কার। মানে নির্বাচনকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে একটি পক্ষ। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে সেকেন্ড রিপাবলিক। দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষের সেকেন্ড রিপাবলিক সম্পর্কে ধারণা নেই। এনসিপিতে মাঠ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : দীর্ঘদিন যুবদলের কমিটি নেই, আপনার ওপর কোনো চাপ আছে কি না?

মোনায়েম মুন্না : ‘আমার ওপর কোনো ধরনের প্রেশার নেই। স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছি। ফেনী, দিনাজপুর, খুলনা জেলা ও মহানগর, যশোর জেলাসহ ইতোমধ্যে অনেক কমিটি গঠন করেছি। সব জায়গায় মতামতের ভিত্তিতে মাঠের নেতৃত্বকে কমিটিতে আনার চেষ্টা করেছি। শিগগিরই যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি আসতে পারে।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : যুবসমাজ-তরুণদের নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী?

মোনায়েম মুন্না : “৩১ দফার মাধ্যমে আমাদের বার্তা দিয়েছি। ইতোমধ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পরিবারভিত্তিক ‘ফ্যামিলি কার্ডের’ কথা বলেছেন। যুবসমাজের ভাবনা নির্বাচনের আগেই আমরা জাতির সামনে তুলে ধরব। ইতোমধ্যে আমরা ১৮ মাসে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের কথা বলেছি। তাদের কাজে-কর্মে সম্পৃক্ত করাই আমাদের লক্ষ্য এবং হাইকমান্ডের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা কাজ করব। সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়াসহ বিদেশে শ্রমবাজারে দক্ষ জনবলের প্রচুর চাহিদা। ফলে উন্নত ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : দেশের এক কোটি যুবক মাদকাসক্ত, তাদের নিয়ে আপনাদের ভাবনা কী?

মোনায়েম মুন্না : ‘যুবসমাজকে কাজ-কর্মে ব্যস্ত রেখে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারলে মাদকাসক্তদের নিয়ে আলাদা কর্মপরিকল্পনা দরকার নেই। যদি মাদক চোরাচালান লাইন ও কেনা-বেচার সিস্টেম বন্ধ এবং পর্নোসাইট বন্ধ করা যায় তাহলে তরুণ সমাবেশের মধ্যে মাদকাসক্তের পরিমাণ কমে আসবে। মাদকের সঙ্গে সীমান্তকেন্দ্রিক একটি চক্র কাজ করছে, এই লাইন বন্ধ করা জরুরি। এখানে প্রশাসনের লোকও জড়িত রয়েছে। এটা নির্বাচিত সরকার ছাড়া বন্ধ করা সম্ভব না। নির্বাচিত সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, সেটা অন্য কেউ নিতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশ শতভাগ কন্ট্রোল করতে পারে না। কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে কমানো সম্ভব। যদি শক্তিশালী প্রশাসন থাকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি সঠিক ভূমিকা রাখে এবং রাজনীতিবিদরা যদি ভূমিকা রাখেন তাহলে কমিয়ে আনা সম্ভব।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : ছাত্রদের দুজন প্রতিনিধি উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন, এতে নির্বাচন প্রভাবিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন?

মোনায়েম মুন্না : ‘উপদেষ্টা পরিষদ থেকে অতিবিলম্বে ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। এনসিপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার কারণেই লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ, মুরাদ নগর, হাতিয়ায় ঝামেলা হয়েছে। বিগত সাড়ে ১৬ বছরে সুশীল সমাজের দুই-একজন প্রতিনিধি ছাড়া কিন্তু কেউ জেলে যায়নি। রিস্কেও ছিল না। রাজনীতিবিদরা বেশি রিস্কের মধ্যে ছিল। নেতাকর্মীরা গুম-খুন হয়েছে, জেল-জুলুম খেটেছে।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : নির্বাচন নিয়ে কোনো ধোঁয়াশা দেখছেন?

মোনায়েম মুন্না : ‘কোনো কোনো মহল নির্বাচনকে বিলম্বিত-প্রলম্বিত করার চেষ্টা করছে। জনগণ এটা মেনে নেবে না। জোর করে ক্ষমতায় থাকার রেজাল্ট কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ বারবার দিয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যাকারী অনেক পুলিশ, আমলা এবং ফ্যাসিস্টের দোসররা এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। নির্দেশদাতারা দেশ থেকে পালিয়ে গেল। গণহত্যার বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই। এটা কার দায়িত্ব? যারা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে তাদের। তারা শুধু সংস্কার সংস্কার করছে, কিসের সংস্কার হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশ : সর্বশেষ কী বলবেন?

মোনায়েম মুন্না : ‘সবার আগে বাংলাদেশ। উন্নত বাংলাদেশ চাই, যোগ্য নেতৃত্ব চাই, সঠিক নেতৃত্ব চাই। আমি মনে করি, ডিসেম্বররের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আর কালবিলম্ব করার সুযোগ নাই। কারণ জনগণের অধিকারকে খর্ব করা যাবে না। ভোটের অধিকারের জন্য আমরা জেল-জুলুম-হুলিয়া-নির্যাতন মাথা পেতে নিয়েছি। সংস্কার করবেন, করেন। সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনকে কেন সাংঘর্ষিক করছেন। সংস্কারও চলবে, নির্বাচনও হবে। নির্বাচনকে কেন ভয় পাচ্ছেন?’

আব্দুল মোনায়েম মুন্না এর আগে দায়িত্ব পালন করেছেন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। লক্ষ্মীপুরে জন্ম নেওয়া মুন্না ১৯৮৫ ছাত্রদলে যুক্ত হয়ে রাজনীতির পথচলা শুরু করেন। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের আন্দোলনে তিনি ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। ২০০৩ সাল থেকে তিনি যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।