আকরাম হোসেন
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:৫৬ এএম
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৫১ এএম
প্রবা ফটো
নির্বাচনের সময়কাল নিয়ে গরম হয়ে উঠেছে রাজনীতির ময়দান। আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে অনড় দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। গত বুধবার আগামী রমজানের আগে জাতীয় নির্বাচনের দাবি করেন জামায়াতের আমির। এর এক দিন পর তিন শর্ত পূরণসাপেক্ষে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেন তিনি। নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির। জুলাই গণহত্যার বিচার, সংস্কার সম্পন্ন করা, আগে স্থানীয় নির্বাচন, এসব শেষে জাতীয় নির্বাচন চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বেশকিছু মতপার্থক্য লক্ষণীয়। বরাবরই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। সম্প্রতি আগামী ডিসেম্বরকে জাতীয় নির্বাচনের কাট অফ টাইম বলে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে দলটি। এদিকে নিজেদের বক্তব্যে স্থির থাকতে পারছে না জামায়াত। রমজানের আগে (ফেব্রুয়ারি) জাতীয় নির্বাচনের দাবি করার এক দিন পরই তিন শর্ত পূরণের পর জাতীয় নির্বাচনের দাবি করেন জামায়াতের আমির। কোনো ধরনের পরিবর্তন ( জুলাই হত্যাকারীদের বিচার, সংস্কার, গণপরিষদ নির্বাচন।) ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মনে করছে এনসিপি। আর এমনটা হলে সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না- সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে বলে জানিয়েছে দলটি। অনেকেই আবার সামাজিক মাধ্যমে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও কয়েকটা বছর রেখে দেওয়ার পক্ষে পক্ষে মত দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন।
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানকে সমাধানযোগ্য মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষায়- সংস্কারের কিছু বিষয়, নির্বাচনে সময়সীমা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য থাকলেও মৌলিক বিষয়ে সবাই এক। আর এই মতপার্থক্য দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান। সরকার উদ্যোগ নিলে এটা সমাধান করা সম্ভব বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, জামায়াত প্রথমে বলেছিল দ্রুত নির্বাচন চায়। তারপর বলল, সকল সংস্কার শেষ করে নির্বাচন চায়। তারপর আবার বলল, নির্বাচন দ্রুতই হতে হবে, নয়তো দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। লন্ডন থেকে ঘুরে এসে বলল, রমজানের আগেই নির্বাচন হতে হবে। নতুন আবার কী বলেছে, এখনও দেখি নাই। তাদের অবস্থান স্থির না। তাদের এসব অবস্থানের ব্যাখ্যা তারাই দিতে পারবেন। তিনি বলেন, বিএনপি জনগণের জন্য রাজনীতি করে। জনগণের পালস বুঝে রাজনীতি করি। জনগণের চাহিদা এখন দ্রুত নির্বাচন, নির্বাচিতদের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। নইলে গণতন্ত্র যেমন আসবে না, তেমনি দেশের স্থিতিশীলতা যা বিনষ্ট হচ্ছে সেটাও ফিরে আসবে না। জনগণের চাহিদাও পূরণ হবে না। একটা অনির্বাচিত শাসন যদি দীর্ঘদিন চলে, তাহলে সেটা জনগণের বিরুদ্ধেই চলে যায়। জনগণ সেখান থেকে কোনো বেনিফিট পায় না। জনগণের কল্যাণে যেহেতু আমরা রাজনীতি করি, আর তাই জনগণের নির্বাচিত শাসন প্রতিষ্ঠা করাটাই সকলের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত।
গত বুধবার জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমাদের ভিউ হচ্ছে, এটা (নির্বাচন) রমজানের আগেই শেষ করতে হবে। জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করলে বর্ষা, বিভিন্ন ধরনের ঝড়ঝাপটা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, তখন আবার ইলেকশনটা (নির্বাচন) অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। সেজন্য আমরা চাইছি, ওই আশঙ্কার আগেই যেন নির্বাচন হয়ে যায়। এর এক দিন পর অর্থাৎ গতকাল তিনি বলেন, জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনটি ‘ম্যান্ডেটরি’ (বাধ্যতামূলক) শর্ত পূরণ হলেই আগামী রমজানের আগে নির্বাচন হতে পারে। তার কথায়Ñ প্রথমত দৃশ্যমান, গ্রহণযোগ্য, মৌলিক সংস্কার; দ্বিতীয়ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যার বিচার ও তৃতীয়ত রাজনৈতিক সহাবস্থান।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব গভীর না। তারা একে অপরকে সহযোগিতা করছে। জামায়াত কৌশলে আগে বিএনপির সঙ্গেও কাজ করেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গেও করেছে। বিএনপি-জামায়াতের যদি একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয় তাহলে সেটা শক্তিশালী ফোর্স হিসেবে মার্চ করবে; যা দেশের স্টাবিলিটি আনবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যত দূরত্ব বাড়বে, ঐক্যের ফাটল ধরবে, একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াবেÑ ততই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল হয়ে যাবে। আলোচনার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর একটা ঐকমত্যে পৌঁছতেই হবে যে, তারা কী ধরনের নির্বাচন চায়। ছাত্রদের নতুন দল গণপরিষদ নির্বাচন চাচ্ছে আর বিএনপি চাচ্ছে রেগুলার ইলেকশন। জামায়াত এ বিষয়ে এখনও পরিষ্কার কিছু বলেনি। আলোচনার মাধ্যমেই রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপকের মত
কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, দেশের সকল মানুষ নির্বাচন চাচ্ছে। হয়তো দিনক্ষণ নিয়ে কারও কারও আপত্তি আছে। কেউ জানুয়ারিতে, কেউ ফেব্রুয়ারিতে, কেউবা ডিসেম্বর অথবা জুনে চাচ্ছে। এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। একইভাবে সংস্কারও সবাই চাচ্ছে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি- সবাই সংস্কার চাচ্ছে। কোন কোন বিষয়ে সংস্কার হবে- এটা নিয়ে তাদের মধ্যে হয়তো মতপার্থক্য আছে কিন্তু সংস্কারের বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য আলাদা। সেই লক্ষ্যে তারা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা নির্ধারণ করবে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের জায়গা থেকে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সবাই নির্বাচন, বিচার, সংস্কার চাচ্ছে- এখানে সবাই একমত। এখন সরকার উদ্যোগ নিলেই ঐকমত্য দেখা যাবে।
তিনি বলেন, ছাত্রদের নতুন দলের সঙ্গে অন্যদের সামান্য মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। এই মতপার্থক্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অংশ। নতুন দল হিসেবে এনসিপি একটু সময় নিতে চাচ্ছে। তারা হয়তো মনে করছে নির্বাচন একটু পরে হলে তাদের জন্য ভালো হয়। অন্যদিকে বিএনপি নেতাকর্মীরা ১৭ বছর ধরে আন্দোলন করেছেন। তাদের মধ্যে নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা রয়ে গেছে। এটা মতপার্থক্য নয়; বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সরকার এটাকে ভালোভাবে নিলে নির্বাচনের তারিখটা আমরা দ্রুত পাব। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। গত সরকারের ডিসকোরসে (উন্নয়নে) নয়; সরকারকে নির্বাচন, সংস্কার এবং গ্রহণযোগ্য বিচার- এই তিন বিষয়ে আরও মনোযোগী হওয়া দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জান্নাত আরা নাজনীন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, সংস্কার হওয়া দরকার। ড. ইউনূস সংস্কার করে যখন মনে করবেন নির্বাচন দেওয়া দরকার তখনই দেবেন। সংস্কার হতে হবে। এতদিনের ময়লা-আবর্জনা জমে আছে, সেগুলো দূর করে, সংস্কার করে যাতে আর কখনও এমন স্বৈরাচারী শাসক আসতে না পারে। এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচন দিক। এটা বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সবার জন্য মঙ্গল হবে। গত ১৭ বছরে আবর্জনা জমেছে তা সংস্কারের মাধ্যমেই দূর করতে হবে। করতেই হবে; না হলে তো একই স্বৈরাচার বারবার ফিরে আসবে। এটা যদি রাজনৈতিক দলগুলো বুঝেও না বোঝার ভান করে তাহলে তো হবে না। সংস্কারে জন্য সময় দীর্ঘ হতে পারে। এতে কিছু যায়-আসে না। ৬ মাসে না হলে ১ বছর, দেড় বছরে হবে। কিন্তু এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, এদেশে আর কোনো স্বৈরশাসক আসবে না।
গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট করে নির্বাচনের ডেটলাইন আমাদেরকে দেননি। তিনি বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টার এই বার্তায় আমরা একেবারেই সন্তুষ্ট নই। ডিসেম্বর হলো আমাদের কাট অফ টাইম। আমরা বিশ্বাস করি, দ্রুত গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমস্যাগুলোর সমাধান হবে।
বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যে যা-ই বলুক না কেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী বছরের জুনের পরে সাধারণ নির্বাচনে যাবে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের বিলম্ব করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের তিনটি দাবি- বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচন। ন্যূনতম সংস্কার নয়, বরং মৌলিক সংস্কার, রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তনের জন্যই আমরা কাজ করছি। কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই নির্বাচনের দিকে গেলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সে নির্বাচনে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশগ্রহণ করবে কি না- সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, সরকারপ্রধান থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। এখন এটুকুই আমাদের কর্মপ্রাধিকারের মধ্যে আছে। এনসিপি রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তাদের রাজনীতি করে। তাদের দাবি তারা কীভাবে আদায় করবে, সেটা তাদের ব্যাপার। এটার সঙ্গে সরকারের নির্বাচনের ঘোষণার ব্যত্যয় ঘটার কোনো কারণ দেখি না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এই আলোচনার মধ্য দিয়ে তাদের লক্ষ্য একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা, যার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে একটি স্থায়ী গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়। বারবার আমাদের দেশের গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে। এগুলো যাতে আর না ঘটে এবং যার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করেছে, তার প্রাতিষ্ঠানিক একটি রূপ দেওয়ার জন্য আমাদের এই আলোচনা।
আলী রীয়াজ আশা প্রকাশ করে বলেন, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এমন একটি জায়গায় উপস্থিত হতে পারব, যা প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংবিধানিকভাবে দেশের ভবিষ্যৎ তৈরি করবে।