আকরাম হোসেন
প্রকাশ : ১০ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:০২ এএম
আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৩৭ এএম
দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। দলটি প্রথমে জেলাভিত্তিক সমাবেশ করবে এবং পর্যায়ক্রমে মহানগর ও বিভাগীয় সমাবেশ আয়োজন করবে। সরকারকে নির্বাচনের জন্য ধাপে ধাপে চাপ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বিএনপি এসব কর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এসব সমাবেশ চলতি মাসের শেষের দিকে অথবা আগামী মাসের শুরুতে শুরু হবে। শিগগির এসব কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিবে দলটি। পাশাপাশি সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সরকারকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ জানাতে চাপ দেবে।
তবে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডা. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করবে বিএনপি। ইতোমধ্যে বৈঠকের জন্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে সময় চেয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১৬ এপ্রিল বিএনপিকে সময় দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বৈঠকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবিতে আলোচনা হবে। ওই দিন দুপুর ১২টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এই সাক্ষাৎ হতে পারে। এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন আগামী ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
তবে বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন নিয়ে নানা মহল থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। নির্বাচন বিলম্বিত করতে তৎপর একাধিক পক্ষ। সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেও কেউ কেউ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল চায় না দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। তারা একের পরে এক গুজব, অপপ্রচার চালাচ্ছে। আগে আওয়ামী লীগ চাইত না, এখন তারা চায় না। দেশি-বিদেশি শক্তি কাজ করছে। ছাত্রদের নতুন দল হয়েছে। তারা হয়তো নির্বাচনের জন্য সময় চায়, নানা টালবাহানার কথা বলে নির্বাচনের প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলছে। এটা তাদের কৌশল হতে পারে। কিন্তু কারও জন্য নির্বাচন আটকে থাকতে পারে না।
তারা বলছে, গত ১৬-১৭ বছর দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো এতদিন ধরে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করে আসছে। দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচন অপরিহার্য। আবার অনির্বাচিত সরকার দীর্ঘ সময় দেশ চালালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। তা ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রকৃত মনোভাব বুঝে উঠতে পারছে না বিএনপি। যতই দিন যাচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতা বাড়ছে বলে মনে করছে দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করার জন্য সময় চেয়েছি। তার সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই আমরা নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলব। আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুনির্দিষ্টভাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের আগে একটা রোডম্যাপ অবশ্যই আমরা চাইব। যাতে তিনি ক্লিয়ালি জাতির সামনে যথাযথ প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা জুনের মধ্যে সমস্ত প্রস্তুতি সমাপ্ত করতে পারবে। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। যেহেতু বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্যে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে সেটা পরিষ্কার করার জন্য আমরা তার কাছে এ আহ্বান জানাব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেছেন, নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের দাবি জানাতে থাকব। বিএনপি নির্বাচনের দাবি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ যৌক্তিক দাবিতে আগে অনেক কর্মসূচি করেছে, প্রয়োজনে আবার করবে। গত ১৫-১৬ বছর ধরে আমরা সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলে আসছি। এটার জন্যই আন্দোলন হয়েছে, রক্ত ঝরেছে, মানুষ মারা গেল। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই চাইতে পারি। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এই চাওয়াটা অন্যায় না।
তিনি বলেন, একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য যতটুক সংস্কার প্রয়োজন সেটা করে নির্বাচনটা দিতে বলেছি। এটা তো আমরা বলব, এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল। আন্দোলনে ছাত্ররা ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তাদের আন্দোলন তো সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না। আন্দোলন ছিল কোটার। ফাইনালি সরকার পতন হয়েছে। ছাত্রদের যেমন ভূমিকা আছে তেমনি সাধারণ জনগণেরও ভূমিকা আছে। সাধারণ জনগণকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আমরাও ভূমিকা রাখেছি।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এখনই নির্বাচন চায় না- এ প্রসঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, তারা তাদের কথা বলছে। যারা চান না তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করেন। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করি। এত বছর ধরে নির্বাচন হচ্ছে না, জনগণ ভোট দিতে পারছে না। দেশের মালিক জনগণ। জনগণ ভোট দেবে, তারা সিদ্ধান্ত নেবে কে সংসদে যাবে, কে সরকার গঠন করবে। এটা তাদের এখতিয়ার।
গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, নির্বাচন হবে। নির্বাচন ঠেকানোর মতো সাহস কারও নেই। তবে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। এটা এখন আমরা দাবি করছি। কিন্তু আমরা প্রমাণ করে ছাড়ব ডিসেম্বরেই নির্বাচন দিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের আমরা সমর্থন করি। আপনাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। এই শ্রদ্ধা ভালোবাসা নষ্ট করবেন না। বিএনপিকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করবেন না। বিএনপি রাস্তায় নামার আগেই নির্বাচন দিন। বিএনপি রাস্তায় নামলে কী হবে শেখ হাসিনার দিকে তাকান। বিএনপি যে কয়বার ক্ষমতায় আসছে জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা নিয়ে।
বিএনপির পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করতে চায়। দ্রুত বিএনপির সঙ্গে সমমনাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, দ্রুত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে আমরা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করব। গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকারকে প্রেশার দেব। একটা অনির্বাচিত সরকার থাকলে দেশে কখনওই স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে না। আমাদের তরফ থেকে সেই পথেই হাঁটব। সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হবে। কিন্তু সেটা আমরা চাই না, কারণ আমাদের আন্দোলনের ফসল এই সরকার। আমরা চাই তারা (সরকার) নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দিয়ে দ্রুত সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করুক। গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করুক।
তিনি বলেন, আমাদের কর্মসূচি হবে গণতান্ত্রিকভাবেই হবে। সভা সমাবেশ হতে পারে। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই করব। জনগণ ভোট দিতে চায়। বিএনপির সঙ্গে আমাদের দ্রুতই বৈঠক হবে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক হতে পারে। সেখানে আমাদের কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা হবে।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়কারী ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, প্রথম থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডা. ইউনূসের ওপর আমাদের সমর্থন রয়েছে। শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে বলেই গত ১৬ বছর দেশের জনগণসহ আমরা আন্দোলন করেছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছে ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। অন্যান্য উপদেষ্টা বলেন জুনে। আমরা চাই প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্টভাবে রোডম্যাপ জানাক। যদি তিনি দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা না করেন তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব কী করা যায়।
স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। আমরা চাই আগামী নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এ জন্য নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অস্পষ্ট। ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাস। এখনও কোনো রোডম্যাপ প্রকাশিত হয়নি। আমরা স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মন্তব্য করেন, সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন হলে সেটি মেনে নেওয়া হবে না। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক মহলে নতুন একটি দাবির কথা উঠে এসেছে, যেখানে ইউনূস সরকারকে অন্তত ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সম্প্রতি ফেসবুকে এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (উত্তরাঞ্চল) এ দাবি করেন।