আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে নতুন মঞ্চের ঘোষণা

‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ মঞ্চ’ নামে একটি নতুন প্লাটফর্মের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই প্লাটফর্ম আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন সংগঠকরা। এ প্লাটফর্ম ঘোষণা করেন ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী এবি জুবায়ের। গতকাল শুক্রবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে’ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এর আগে একই দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করে ইনকিলাব মঞ্চ। তাদের মিছিল থেকেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়।

জুলাই অভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন দলটির সভাপতি ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতার চূড়া থেকে পতিত হওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এরপর নানা ইস্যু সামনে আসায় হাওয়ায় মিলিয়ে যায় দলটিকে নিষিদ্ধের আওয়াজ। তবে গত বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই অন্তর্বর্তী সরকারের’ মন্তব্যের পর ফের নতুন করে সামনে এসেছে এ দাবি। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের পর নড়েচড়ে বসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও সংগঠন। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বের অগ্রভাগে থাকা তরুণরা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার। এ ইস্যুতে সামাজিকমাধ্যমেও তারা সরব। আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধের বিষয়ে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ‍উপদেষ্টা, বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, গণঅধিকার পরিষদ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ ছাত্রনেতারা। 

গতকাল বিকালে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে কেউ ঐক্যে ফাটল ধরাতে আসবেন না বলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘নির্বাচন পিছিয়ে যাবে, অনিশ্চয়তা তৈরি হবেÑ এসব শঙ্কার কথা বলে কেউ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে জনতার ঐক্যে ফাটল ধরাতে আসবেন না।’ 

নির্বাচনের তারিখ পেছাবে না জানিয়ে তিনি লেখেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্পষ্টভাবে বারবার বলছেন, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইলেকশন হবে। আমি নিশ্চয়তা দিতে চাই, সরকার এই কথা রাখবে।’ 

এদিকে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গতকাল রাজধানীর লেডিস ক্লাবে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের সম্মানে বিএনপির ইফতার আয়োজনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, ‘পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া যাবে না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে না, যেন রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পায়।’ 

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ গতকাল মধ্যরাতে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে।’ তিনি এই পরিকল্পনাকে পুরোপুরি ভারতের বলেও অভিহিত করেন। 

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানও গতকাল সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘বাংলাদেশের নির্যাতিত ১৮ কোটি মানুষের দাবি, গণহত্যাকারীদের বিচার, ২৪-এর শহীদ পরিবারগুলোর পুনর্বাসন, আহত এবং পঙ্গু অসংখ্য ছাত্র, তরুণ, যুবক ও মুক্তিকামী মানুষের সুচিকিৎসা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে ১৫ বছরের সৃষ্ট জঞ্জালগুলোর মৌলিক সংস্কার সাধন করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা। জনগণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই গণহত্যার বিচারটাই দেখতে চায়।’

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ চায় হেফাজতে ইসলামও। সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক গতকাল জুমার নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর ফটকে বিক্ষোভ সমাবেশে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের কোনো চেষ্টা বরদাশত করা হবে না। যদি দেশে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা আমাদের লাশের ওপর দিয়ে করতে হবে।’ 

এদিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও গণহত্যার বিচারের দাবিতে গণঅধিকার পরিষদ গতকাল পুরানা পল্টনে সংগঠনটির কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও গণমিছিল কর্মসূচি পালন করেছে। এখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে গণঅধিকার সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমরা লক্ষ্য করছি আওয়ামী লীগের কালো টাকার লোভে অনেক রাজনৈতিক দল তাদের রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ছাত্র সমন্বয়করা তদবির করে আওয়ামী লীগের দোসরদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে আর দোষ চাপাচ্ছে সেনাবাহিনী ও সরকারের ওপর।’ 

এদিকে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মপ্রকাশ করা ‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ মঞ্চ’ নামে গঠিত প্লাটফর্ম থেকে ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী এবি জুবায়ের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আমরা আপনার ওপর আস্থা রাখতে চাই, আপনি আওয়ামী লীগ ইস্যুতে গণভোটের আয়োজন করে দেখুন মানুষ কী চায়। মানুষ রায় দেবে তারা চায় না। আপনি আপনার সাম্প্রতিক বক্তব্যের ব্যাখা দেবেন বলে আশা করছি।’ 

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মুহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের এই প্লাটফর্ম থেকে আজ (শুক্রবার) বিকাল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে, গণইফতার ও অবস্থান কর্মসূচি পালিত হবে।’ 

ইনকিলাব মঞ্চ নামে একটি সংগঠন ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে গতকাল কর্মসূচি পালন করেছে। এ সময় সংগঠনের সদস্যরা ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই’Ñ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। এ সময় তারা ‘আওয়ামী লীগের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে’, ‘একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জেলে ভর’, ‘ইউনূস সাহেবের বক্তব্য, প্রত্যাহার করতে হবে’, ‘বিচার বিচার বিচার চাই, গণহত্যার বিচার চাই’, ‘আওয়ামী লীগের বিষদাঁত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ, করতে হবে করতে হবে’ বলে স্লোগান দেন। ইনকিলাব মঞ্চের মিছিলেও ‘খুনি লীগের পুনর্বাসন, রুখে দাও জনগণ’, ‘জুলাইয়ের বাংলায়, গণহত্যাকারীদের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ডও দেখা যায়।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদী বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিয়ে নির্বাচন করতে চাইলে বাংলাদেশে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে।’ 

গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব জাহিদ আহসান বলেন, ‘যারা জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিরোধিতা করেনি তারা কখনও ভালো হতে পারে না। ভালো আওয়ামী লীগ বলতে কিছু হয় না।’

গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব মহির আলম বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিনটা মৌলিক দাবি পূরণের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সংস্কার, নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের বিচার এ তিন লক্ষ্য পূরণের কথা ছিল। সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা এবং কাজ চলমান থাকলেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না হলে রাজপথ ছাড়বে না।’ 

এদিকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও জুলাই গণহত্যার বিচার দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে গতকাল শুক্রবার বিভিন্ন সময়ে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি করেন শিক্ষার্থীরা।