প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৫ ১০:৪০ এএম
আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৫ ১৫:১৬ পিএম
গ্রাফিক্স : প্রবা
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন পৃথিবীতে নজির সৃষ্টি করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস। সংস্কার ও নির্বাচন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেছেন জানান রাজনৈতিক নেতারা। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জাতিসংঘের উদ্যোগে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠক শেষে দ্রুত সংস্কারের বিষয়টি জাতিসংঘ মহাসচিবকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মৌলিক সংস্কারের ভিত্তি এই সরকারের সময়েই করতে হবে মত দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। নিরপেক্ষ নির্বাচন ও গনতন্ত্রকে টেকসই করতে তাদের বক্তব্যকে গুতেরেস সমর্থন করেছেন বলে জানান জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মো. তাহের। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা জাতিসংঘের মহাসচিবকে বলেছি সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। আমরা সংস্কারের কথা আগেই বলেছি। সংস্কারটা যত দ্রুত করা যায়। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এই বিষয়টি অবহিত করেছেন। আমরা আমাদের বক্তব্যের মধ্যে যে কথাগুলো বলে আসছি, সেই একই কথা বলেছি। কিন্তু আমরা যেটা বলেছি, মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক যে সংস্কারগুলো আছে সেগুলো করে ফেলা এবং দ্রুত নির্বাচন করে বাকিগুলো সংসদের মাধ্যমে করে ফেলা। সংস্কারগুলো চলমান প্রক্রিয়া সেই বিষয়গুলো আমরা বলে এসেছি।
আপনাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের জবাব কী ছিল জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, তিনি এ ব্যাপারে কোনো কমেন্ট করেননি। গোলটেবিল বৈঠকে সংস্কারের বিষয়ে কোনো সময়সীমার কথা আপনারা বলেছেন কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওখানে টাইমফ্রেম নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটা তো আমাদের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা তো সংস্কার কমিশনের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এবং তারা যা চাচ্ছে আমরা দিয়েছি। ইতোমধ্যে আমাদের সঙ্গে একটা বৈঠক হচ্ছে। ফলে সেই বিষয়গুলো নিয়ে তো প্রশ্ন উঠতে পারে না। জাতিসংঘের মহাসচিবকে আমরা টাইমফ্রেম দিতে যাব কেন?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংস্কার ও নির্বাচন কীভাবে হবে, সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে জাতিসংঘ মনে করে। এ দেশের জনগণকেই তা নির্ধারণ করতে হবে। তবে জাতিসংঘ মহাসচিব আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, বাংলাদেশে আগামীতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, পৃথিবীর মধ্যে একটা নজির সৃষ্টি করবে আগামীর নির্বাচন।
বৈঠক শেষে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জামায়াতের পক্ষ থেকে আমি এবং দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। পরে সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আমরা সংস্কার এবং একটা ফেয়ার নির্বাচনের ব্যাপারে কথা বলেছি। টেকসই গণতন্ত্রের ব্যাপারে কথা বলেছি। জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে কথা বলেছি। তিনি জানান, জাতিসংঘ মহাসচিবও আমাদের বেশিরভাগ বক্তব্যে সমর্থন প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের সিদ্ধান্তে আমাদের কাজে সহযোগিতা করবেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। তাকে জামায়াতের পক্ষ থেকে আমরা ধন্যবাদ জানিয়েছি।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, মৌলিক সংস্কারের ভিত্তি এই সরকারের সময়েই তৈরি করতে হবে এবং সব রাজনৈতিক দল মিলে একটি ঐকমত্য পোষণ করতে হবে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে। জনগণের কাছে আমাদের সংস্কারের যে কমিটমেন্ট, সংস্কারের যে ধারাবাহিকতা, সেটা বাস্তবায়নের জন্য জুলাই সনদের দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলেছি। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটাই আলোকপাত করা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রধানরা তাদের স্ব স্ব সংস্কার রিপোর্টের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছিলেন। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা তাদের দলীয় অবস্থান সংস্কার বিষয়ে তুলে ধরেছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষে আমাদের সংস্কার বিষয়ে যে অবস্থান, আমরা মনে করি, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যে সরকার গঠিত হয়েছে, বিচার ও সংস্কার জনগণের কাছে তাদের অন্যতম কমিটমেন্ট।
সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে কোনো আলোচনা করেছেন কি না প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, এখানে বিস্তারিত আলাপের সুযোগ ছিল না। আমরা সংস্কার বিষয়ে ওভারঅল আলোচনা করেছি। গণপরিষদের মাধ্যমেই সংস্কার করতে হবে, অন্যথায় সংসদের সংবিধান সংস্কার টেকসই হবে না, বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেও এটাই দেখতে পাই। সেই জায়গা থেকে আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাচ্ছি। সামনের যে জাতীয় নির্বাচন সেটা একই সঙ্গে আইন পরিষদ ও গণপরিষদ নির্বাচন হোক।
এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকার, তারা যেন নিজেরাই সমঝোতায় আসে। একটা ঐকমত্যে আসে। গণতন্ত্রের ট্রু এসেন্স, সেটাকে মাথায় রেখেই যেন আমরা একসঙ্গে কাজ করি, একটি ঐকমত্যে আসতে পারি সেটাই তিনি তার জায়গা থেকে বলেছেন।’
নির্বাচন সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তার ভাষ্য, আমরা মনে করি এবং আমরা এটাই বলেছি যে, নির্বাচন কিন্তু আমরা সংস্কারের একটা প্রক্রিয়া হিসেবে দেখি, সংস্কারের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখি। কোনো রকম সংস্কার ছাড়া বা সংস্কারবিহীন নির্বাচন কোনো কাজে দেবে না। অন্য সব রাজনৈতিক দলও এটার সঙ্গে একমত পোষণ করে। এখানে মতপার্থক্যগুলো হচ্ছে, কোন সংস্কার কখন হবে, নির্বাচনের আগে কতটুকু হবে নির্বাচনের পরে কতটুকু হবে, এটা নিয়ে। আমরা মনে করি যে, জুলাই সনদের মধ্যে সেটা বাস্তবায়ন হলে মতপার্থক্যগুলো কেটে যাবে এবং আমরা একটা ঐকমত্যে আসতে পারব।
বিচারের বিষয়ে জাতিসংঘের কোনো সহযোগিতা চেয়েছেন কি না জানতে চাইলে এনসিপি নেতা বলেন, আমরা তাদের কাছে বিচার ও সংস্কার বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছি। ধন্যবাদ জানিয়েছি। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ‘আমরা যেন নিজেরা ঐকমত্যে আসতে পারি। আমরা যদি নিজেরা ঐকমত্যে আসতে পারি, তারা তাদের জায়গা থেকে সহযোগিতা করবেন।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে জুলাই গণহত্যার বিচার নিশ্চিতে জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্য নিয়ে আমাদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে সংস্থাটির সাহায্য প্রয়োজন। এখনও জাতিসংঘের তিনটি প্রতিষ্ঠানে শেখ হাসিনার আত্মীয়রা কাজ করছেন। এবি পার্টি মনে করে বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে সর্বপ্রথম জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় শেখ হাসিনা পরিবারের যেসব আত্মীয় রাষ্টীয় স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছে এবং সেগুলোর অপব্যবহার করেছে দেশের জনগণের বিপক্ষে সেগুলো খতিয়ে দেখা দরকার।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এবং সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে চার দিনের সফরে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসেন আন্তনিও গুতেরেস।