প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ১২:১৫ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে মন্তব্যের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের অনেকেই রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ দাবি করেছেন। একই সঙ্গে তারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর আইন ও সংবিধানের বিষয়টিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির তীব্র সমালোচনা করলেও তার পদত্যাগ কিংবা অপসারণের দাবির প্রশ্নে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি বলেছে, তারা এ মুহূর্তে কোনো সাংবিধানিক সংকট চায় না। আর জামায়াতে ইসলামী এ ইস্যুতে একেবারে নিশ্চুপ রয়েছে। দায়িত্বশীল নেতারা গণমাধ্যমের কাছে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করছেন না। তবে দলটির আমির গত সোমবার ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের এই মহান দায়িত্বে থাকার নৈতিক ও আইনগত অধিকার হারিয়েছেন।’
বিএনপি বলেছে, রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে এ মুহূর্তে দেশে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হোক তা তারা চায় না। নতুন করে এমন কোনো সংকট যেন সৃষ্টি না হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেছে দলটি। গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির তিন জ্যেষ্ঠ নেতা দেখা করে এমন কথাই বলে এসেছেন। তিন নেতা হলেনÑ দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমেদ।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেইÑ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবি তুলেছে। তিনি ‘মিথ্যাচার করে শপথভঙ্গ করেছেন’ বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও। এমন পটভূমিতে বিএনপির তিন নেতা যমুনায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নজরুল ইসলাম খান। এ সময় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে কোনো কিছু জানতে চাওয়া হয়েছিল কি না বা আপনারা কিছু বলেছেন কি নাÑ জানতে চাইলে জবাবে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট করে নয়, আমরা বলেছি, দেশে নতুন করে সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেখছি, পতিত ফ্যাসিবাদ এবং তাদের দোসরেরা নানা কৌশলে, নানাভাবে দেশে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমরা মনে করি, দীর্ঘদিন লড়াই করে রক্তের বিনিময়ে আমরা যে পরিবর্তন অর্জন করেছি, সেই পরিবর্তন সুরক্ষায় এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের জাতীয় ঐক্য আরও সুদৃঢ় করা দরকার। এখানে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশার সংগঠন, ছাত্র-যুবক—সবার একটি দৃঢ়তর ঐক্য গড়ে তোলা দরকার, যাতে কেউ দেশে নতুন করে সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। সে ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে।’
নজরুল ইসলাম খান মন্তব্য করেন, পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরা যদি কোনো সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালায়, তাহলে গণতন্ত্রকামী ও আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবিলা করবে।
আলোচনার বিষয়বস্তু বলতে গিয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘সংস্কারের কাজ দ্রুত করা এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেই সংস্কারগুলো করা, জনগণের চলমান সংকটগুলো দ্রুত নিরসন করা, সর্বোপরি এই আন্দোলনের মূল আকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’ তিনি এ নিয়ে আরও বলেন, ‘দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য যে সংস্কারপ্রক্রিয়া চলছে...সেই সংস্কার দ্রুততম সময়ে করে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ চালিয়ে আসছি। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে আমরা আলোচনা করছি। দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণ যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা দূর করার ব্যাপারে সরকারকে আরও কঠোর ও কার্যকর ভূমিকা পালনের কথা বলেছি।’
এর পর গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ তার দল রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা অপসারণ চায় কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক সর্বোচ্চ পদ। এটি কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। রাষ্ট্রপতি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। ফলে এ মুহূর্তে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি কাম্য নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ ও তাদের দোসরেরা দেশে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় সংকট তৈরির চেষ্টা করছে। সে ব্যাপারে সবার সজাগ থাকা প্রয়োজন। বিএনপি ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐকবদ্ধ থাকার আহ্বান জানাচ্ছে।’
এর আগে গত মঙ্গলবার রাতেই রাষ্ট্রপতিকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক দিনের ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করেছে দলটি। দলের নেতারা মনে করেন, যেভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেটি নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এর পরপরই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি, বঙ্গভবন ঘেরাওসহ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা সেই সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে। দলের নেতারা মনে করছেন, পুরো প্রক্রিয়া নিয়েই দুরভিসন্ধি আছে।
দলের একাধিক নেতা বলেন, রাষ্ট্রপতিকে সরানোর পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার প্রক্রিয়া আছে কি না, তা নিয়ে ভাবছেন তারা। কারণ সরকারের বক্তব্যে সংসদ নির্বাচনের কথা স্পষ্ট না হওয়াতে নানা ধরনের আলোচনা আছে। তা ছাড়া আইন ও সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এখন সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে আরও কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলোচনা করে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাতে রাষ্ট্রপতি কোন প্রেক্ষাপটে, কতটা সিরিয়াসলি ওই কথা বলেছেনÑ তা-ও বোঝার চেষ্টা করছে বিএনপি। তবে দলের নেতাদের প্রায় সবাই একমতÑ বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা ঠিক হবে না।
ফেসবুকে সরব, মুখ বন্ধ জামায়াতের
জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির তীব্র সমালোচনা করলেও তার পদত্যাগ কিংবা অপসারণের দাবির প্রশ্নে নিশ্চুপ রয়েছে। দলটি শুধু বলেছে ‘রাষ্ট্রপতি অসত্য বক্তব্য দিয়ে ওই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন’।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ফেসবুকে গত সোমবার একটি পোস্ট দেন। সেই পোস্টটি জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার তার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে গতকাল তুলে ধরেছেন। দীর্ঘ এ পোস্টে জামায়াত আমির বলেছেন, ‘মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক জনাব মতিউর রহমান চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি যা বলেছেন তাতে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। তার ৫ আগস্টের বক্তব্য এবং ১৯ অক্টোবরের সাক্ষাৎকারটি স্পষ্টত স্ববিরোধী। যদি তিনি জনাব মতিউর রহমান চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎকার দিয়ে থাকেন এবং উল্লেখিত কথাটি বলে থাকেন, তাহলে রাষ্ট্রপতি ৫ আগস্টের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সামনে বক্তব্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে স্পষ্টত তিনি তার শপথ ভঙ্গ করেছেন। ফলে তিনি রাষ্ট্রের এই মহান দায়িত্বে থাকার নৈতিক ও আইনগত অধিকার হারিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিকে অনতিবিলম্বে তার অবস্থান স্পষ্ট করে জনমনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলছেন, ‘রাষ্ট্রপতি নিজেই বলেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র তিনি পেয়েছেন আর পরে সাংবাদিকদের বলছেন পাননি। এর অর্থ হলো এখন তিনি মিথ্যা বলছেন, যা শপথভঙ্গের নামান্তর। এর মাধ্যমে তিনি ওই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন।’ তবে জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ কিংবা অপসারণ চায় কি-নাÑ এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি তিনি।
এ নিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরও কোনো মন্তব্য করতে চাননি। রাষ্ট্রপতি নিয়ে চলমান সংকট ঘিরে জামায়াতের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি গতকাল সন্ধ্যায় প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এ নিয়ে এ মুহূর্তে কোনো কমেন্ট করতে চাই না।’
অস্থিতিশীলতা চায় না গণতন্ত্র মঞ্চ
রাষ্ট্রপতিকে কেন্দ্র করে পতিত সরকার দেশে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করুক তা চায় না গণতন্ত্র মঞ্চ। পাঁচ দলের সমন্বয়ে গঠিত এই জোটের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গতকাল সন্ধ্যায় প্রতিদিনের বাংলাদেশকে এমন কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘জনগণ যে সরকারকে উচ্ছেদ করেছে, উৎখাত করেছে, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেন কি করলেন নাÑ এটা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। তিনি কি কাগজ দিয়ে গেলেন বা গেলেন নাÑ এর কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। সুতরাং এটাকে যারা সামনে এনে জল ঘোলা করতে চান, তাদের হয়তো অসৎ কোনো উদ্দেশ্য কাজ করতে পারে। আমরা খুব পরিষ্কার করে বলতে চাইÑ নানা ধরনের অপশক্তি এখানে তৎপর রয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে কেন্দ্র করে আমরা এমন কোনো পরিস্থিতি দেখতে চাই না যে পরিস্থিতিতে উত্তেজনা তৈরি হবে, অন্তর্বর্তী সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে, বিতর্কিত হবে, সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, আবার পতিত সরকার এই পরিবেশের কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে একটা অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে, তা আমরা দেখতে চাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে। আমি মনে করি, তার আগের বক্তব্য ও বর্তমানে দেওয়া ব্যাখ্যায় সংকটের আপাতত সমাধান হয়েছে। তবে রাষ্ট্রপতি পদের যে মর্যাদা ও গুরুত্ব এমন একটি পদে থেকে এ রকম স্ববিরোধী বক্তব্য দেওয়া উচিত হয়নি। এটা এ পদের যে সম্মান ও মর্যাদা তা তার সঙ্গে যায় না। এটা একধরনের নৈতিকস্খলনের পর্যায়েও পড়ে।’