মেরিনা লাভলী, রংপুর
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪ ১০:২৮ এএম
ফাইল ফটো
আওয়ামী লীগের সাথে জোটে যাওয়ায় জাতীয় পার্টিকে বেশ খেসারত দিতে হচ্ছে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তারা সহযোগিতা যে দিয়েছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন বলে রংপুর জাতীয় পার্টির নেতারা জানিয়েছেন। এ জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন করে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। কমিটিকে সক্রিয় রাখার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির বলেন, দলের চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমরা রংপুর মহানগরের ৩৩টি ওয়ার্ডে কমিটি শক্তিশালীকরণে কাজ করে যাচ্ছি। খুব দ্রুতই ৬টি থানায় কমিটি করা হবে। রংপুর সদর উপজেলায় নতুন কমিটি গঠন করা হচ্ছে। কুড়িগ্রাম জেলা কমিটি ভেঙে দিয়ে সেখানেও নতুন কমিটি করা হবে। এ ছাড়া তৃণমূল থেকে ত্যাগী তরুণ নেতাদের দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে।
রংপুর একসময় জাতীয় পার্টির ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এসএম ইয়াসির বলেন, রংপুরের মানুষ জাতীয় পার্টিকে ভালোবেসে দলের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতেন। সংসদ সদস্যরাও রংপুরের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। কিন্তু সেই জনপ্রিয় আসনগুলোকে আওয়ামী লীগ জোর করে দখলে নিয়ে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে আমাদের দলের নেতারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলাতে অংশ নিতে পারেনি।
এবার রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টিকে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন নেতারা। বর্তমানে চলছে দল গোছানোর কাজ। ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়ন, জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করা হচ্ছে। নিষ্ক্রিয় কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি দেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে শারদীয় দুর্গা উৎসবকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে জাতীয় পার্টির ভাবনা ও নেতাদের সাথে জনগণের মেলবন্ধন তৈরির চেষ্টা চলছে। দিনরাত পূজামণ্ডপে ছুটে বেড়াচ্ছেন নেতারা।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিগত ১৫ বছরে দলের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আমরা সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কাজ শুরু করেছি। আমাদের যেসব দুর্বলতার জায়গায় রয়েছে, সেগুলো রিকভার করার চেষ্টা করছি। দলীয় চেয়ারম্যানের নির্দেশে মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের উজ্জীবিত করে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে কাজ করব। নির্বাচনের সময় আসলে জোটগত নাকি এককভাবে নির্বাচন করা হবে, তা দলের চেয়ারম্যান আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তিনি বলেন, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে নেতাদের পূজামণ্ডপে গিয়ে জনগণের সাথে মেলবন্ধন বৃদ্ধিতে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নেতারা মণ্ডপে মণ্ডপে গিয়ে মানুষের সাথে কুশল বিনিময় করছেন। আমি নিজেও নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডের পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করছি।
যেভাবে জাপার আসন আওয়ামী লীগের দখলে গেল
পৈতৃক নিবাস রংপুর হওয়ায় জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রংপুর বিভাগে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। একসময় রংপুরের ৬টি আসনই জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুরের সব কটি আসনেই জাতীয় পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের হয়ে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি রংপুর-৪ (পীরগাছা-কাউনিয়া), রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) ও রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসন হারায় এবং বাকি তিনটি আসনে জয়লাভ করে। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচনে এসে রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনটিও হারায় জাতীয় পার্টি। এতে করে রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) ও রংপুর-৩ (সদর) আসন দখলে থাকে দলটির। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো আসন পুনঃরুদ্ধার করতে না পেরে ওই দুই আসনই ধরে রাখতে হয় জাতীয় পার্টিকে। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির রংপুর-১ ও রংপুর-৩ আসনের সমঝোতা হয়। সেই অনুযায়ী দুই আসন থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী তুলে নিলেও রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসনে শক্তিশালী স্বতন্ত্র বিদ্রোহী প্রার্থীকে নির্বাচনে রেখে দেয়। এতে ওই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী পরাজিত হন। ফলে দলটির দুর্গ রংপুরে মাত্র একটি, রংপুর-৩ (সদর) আসন ধরে রাখতে পেরেছিল জাতীয় পার্টি।
দলের নেতারা অভিযোগ করেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার স্ত্রী রওশন এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচনী খেলায় মেতেছিলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেন। সেই সময় এরশাদের স্ত্রী রওশদ এরশাদকে ম্যানেজ করে জাতীয় পার্টির পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেয়। এ ছাড়া সেই সময় দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে প্রেরণসহ দল ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলের চেয়ারম্যান পদ নিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও রওশন এরশাদের মাঝে বিরোধ তৈরি করা হয়েছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলকে টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই বলে জানিয়েছিলেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এভাবে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে এনে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে তাদের আসনগুলো নিজেদের করে নেয় আওয়ামী লীগ।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল জাপা
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের খাবার পানি, অ্যাম্বুলেন্স সহায়তা দিয়ে তোপের মুখে পড়েছিলেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে মোস্তফাকে অপদস্থ করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জাতীয় ছাত্রসমাজ, যুব সংহতিসহ জাতীয় পার্টির বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠন যোগ দিয়েছিল। সরকার পতনের এ আন্দোলনে রংপুরে জাতীয় পার্টির অবস্থান ছিল আন্দোলনকারীদের পক্ষে। কারণ আওয়ামী লীগ জাপাতে কোন্দল তৈরি করেছিল, আসন দখল ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যহার করেছিল।
আগামী ভোটে আওয়ামী লীগের প্রভাব না থাকায় জাতীয় পার্টি অন্য রূপে ফিরবে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এবার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন নেই। আশা করছি আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টি হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারবে।’