কাজী হাফিজ
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৬ এএম
আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:০৭ এএম
ড. বদিউল আলম মজুমদার, ইসি সংস্কার কমিশনের প্রধান। ছবি: সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা নির্বাচনী ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারে পিআর পদ্ধতি চালুর ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন। এ ছাড়া দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথাও বলছেন তারা।
সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত করা এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের সিন্ধান্ত নিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এ কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. বদিউল আলম মজুমদারের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে তিনি কাজও শুরু করেছেন। তিনিও পিআর পদ্ধতি, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে।
গত ২৯ আগস্ট ড. মজুমদারের সংগঠন সুজন থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যেসব সংস্কার প্রস্তাব রাখা হয়, তার অন্যতম হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর ব্যবস্থা। একই সঙ্গে দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন এবং নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার কথাও বলা হয় সেখানে।
প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে ভোটাররা ব্যক্তিকে নয়, দলকে ভোট দেন। দলের ভোট প্রাপ্তির হারের ওপর ওই দল কত আসন পাবে তা নির্ভর করে। ইউরোপের প্রায় সব দেশ এবং পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ বিশ্বের ৯৭টিরও বেশি দেশে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। বাংলাদেশে এ পদ্ধতি চালু করা হলে একটি দল প্রকৃত অর্থেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে। মাত্র কয়েক শতাংশ ভোট কমবেশি হওয়ার কারণে সংসদে আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধান সৃষ্টি হবে না। নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম কমে আসবে। বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পথ বন্ধ হবে। ভোট বর্জন, সহিংসতা ও অন্যান্য অপ্রীতিকর বিষয় দূর হবে। বিজয়ী সবকিছু নিয়ে নেবে, এটা আর ঘটবে না। কারণ এ পদ্ধতিতে কোনো দল নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন চালাতে সমর্থ হতে পারে না।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের ৪০.৮৬ শতাংশ পেয়ে বিএনপি জাতীয় সংসদে আসন পেয়েছিল ১৯৩টি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় মাত্র ৬২টি। অন্যদিকে দেশে বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতির বদলে বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পিআর পদ্ধতি চালু থাকলে ফল হতো ভিন্ন। এ পদ্ধতিতে ওই নির্বাচনে বিএনপি ১২২টির কাছাকাছি আর আওয়ামী লীগ কমপক্ষে ১২০টি আসন পেত।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে দলগুলোর আসন প্রাপ্তিতে সামঞ্জস্য ছিল না। ওই নির্বাচনে ৪৮.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল, অন্যদিকে বিএনপি ৩২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পায় মাত্র ৩০টি। পিআর বা ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন পদ্ধতি থাকলে ওই নির্বাচনে বিএনপি পেত কমপক্ষে ৫৭টি আসন।
এ বিষয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাকে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে, তা জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ থেকে জেনেছি। এ বিষয়ে এখনও কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে বলে জানি না। তবে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। পিআর ব্যবস্থা, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, এগুলো দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদে আইন প্রণয়ন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সংসদের দুটি কক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, যা নির্বাচন অনুষ্ঠানেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এসব ব্যবস্থা চালুর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংস্কার কমিশন গঠন হলে আমরা এসব বিষয়ে সুপারিশ করতে পারি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই এসব বিষয়ে সংস্কার হতে পারে, আবার পরেও হতে পারে। আর নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এটা বলা যায়। কারণ উপদেষ্টা পরিষদ পরিচালিত বর্তমান সরকারও কোনো দলীয় সরকার না।’
গত ২৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ : দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ শিরোনামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে ৯টি কৌশলগত বিষয়ের সুপারিশ তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এসব সুপারিশের অন্যতম ছিল সংসদ নির্বাচনে পিআর ব্যবস্থা এবং নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন।
স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদও মনে করেন, সংসদে সংখ্যানুপাতিক ভোটের পদ্ধতি চালু করা গেলে পরিস্থিতি পাল্টাবে। গত শনিবার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘‘গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমরা দেখেছি, বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে ভোট প্রাপ্তিতে প্রধান দুই দলের মধ্যে তেমন পার্থক্য না থাকলেও সংসদে আসন প্রাপ্তিতে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। এতে ক্ষমতা কাঠামোতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। কিন্তু পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে সেটি হবে না। তখন আদর্শভিত্তিক ছোট দলগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তারা বড় দলগুলোকে চাপ দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে জোট হবে নির্বাচনের পরে আর বড় দলগুলো ছোটদের শর্ত মেনেই সে পথে হাঁটবে।”
দেশে এ পদ্ধতি প্রণয়নের দাবি ওঠে ১৬ বছর আগেই। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে সিপিবির লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে অন্যতম করণীয় হচ্ছে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা প্রবর্তন। এ ব্যবস্থা অনুযায়ী নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদের নিজস্ব এখতিয়ারভুক্ত কাজকর্ম সম্পর্কে প্রস্তাবনা-পরিকল্পনা-কর্মসূচি-নীতি বর্ণনা করে রাজনৈতিক দলগুলো দেশবাসীর সামনে নিজ নিজ ইশতেহার উপস্থিত করবে। দেশবাসী এসব ইশতেহারের মধ্য থেকে যে দলের ইশতেহারে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাবে, সেই দলের মার্কায় ভোট দেবে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে দল জাতীয় সংসদে সেই অনুপাতে প্রতিনিধি পাঠাবে। অর্থাৎ মোট আসন যদি ৩০০ হয়, তাহলে কোনো দল ৫০ শতাংশ ভোট পেলে ১৫০টি আসন পাবে। ঐকমত্যের প্রয়োজনে নতুন ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থাও আংশিকভাবে (অর্ধেক আসনে) অব্যাহত রাখা যেতে পারে। সবার মতামতের ভিত্তিতে এই অনুপাত কমবেশিও করা যেতে পারে। এই ব্যবস্থায় সংসদ সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কাজে দলীয় প্রধানের বা নেতৃত্বের কোটারির স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করার জন্য দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা বিধিবদ্ধভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে।’
২০১১ সালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে সিপিবি ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল একই প্রস্তাব রাখে। সে সময় তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বিষয়টি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এটা হলে নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব কমবে। আবার কিছু অসুবিধাও রয়েছে। আপনারা এ দাবি অব্যাহত রাখেন। একসময় হয়তো বিষয়টি সবার ওপর আছর করতে পারে।’
সদ্য সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিুবল আউয়ালও গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগের সময় তার বিদায়ি ব্রিফিংয়ে আগামী দিনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব রাখেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয়ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে।’
সম্প্রতি সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ আইনেরও সংস্কার প্রয়োজন।’