বাছির জামাল
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৪ ১০:৫৬ এএম
আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২৪ ১১:০৮ এএম
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ চালানোর অভিযোগে স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। একই সঙ্গে জামায়াত ও তাদের সকল অঙ্গসংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জামায়াতের কর্মীবাহিনী কী করবে- এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যেমন- তারা কি ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ চলে যাবে, না নতুন কোনো সংগঠন প্রতিষ্ঠা করবে? নাকি বিদ্যমান কোনো দলে আপাতত আশ্রয় নেবে, কিংবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাবে?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, জামায়াতকে আগেই নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল। কারণ, গত ৩০ বছরে সংগঠনটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছে। তারা এরই মধ্যে সব বিকল্প সৃষ্টি করেই রেখেছে। সমমনা কয়েকটি দলে তাদের কর্মীবাহিনী আশ্রয় নিতে পারে। একত্রিত হতে পারে বিএনপির পতাকাতলেও। এমনকি আশ্রয় নিতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনেও।
বিশেষজ্ঞরা তাগিদ দিয়েছেন, শুধু দল বা সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ নয়; জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণাধীন আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যাতে তারা ভিন্ন নামে রাজনীতি করতে না পারে। আর্থিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ভিত্তি সুসংহত থাকলে নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
নিষিদ্ধ ঘোষণার পর জামায়াত এখন গোপন দলের মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে বলে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বিবৃতিতেও সেই ইঙ্গিত রয়েছে। বৃহস্পতিবার নিষিদ্ধ ঘোষণার পর গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে জামায়াতের আমির বলেছেন, ‘সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেই জামায়াতে ইসলামীর মূল কাজ ইসলামের দাওয়াত, মানুষের চরিত্র সংশোধন ও ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজ কখনও বন্ধ হবে না।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ মনে করেন, জামায়াতের বিশাল কর্মীবাহিনীর একটি বিরাট অংশ বিএনপিতে আশ্রয় নিতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে এবি পার্টিসহ নতুন গঠিত কয়েকটি দলে যেতে পারে। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আমলে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার কারণে জামায়াতের রাজনীতিও নিষিদ্ধ ছিল। তারপর সামরিক সরকারের আমলে বিশেষ করে জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে জামায়াত শক্তিশালী হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তো মন্ত্রিসভায়ও স্থান করে নিয়েছে। বিএনপির ছত্রছায়ায় জামায়াত সব সময় থেকেছে। তাদের সভাসমাবেশকে সফল করায় জামায়াতের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। বর্তমান অবস্থায় তারা বিএনপিতে আশ্রয় নিতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, তাদেরকে নিষিদ্ধ করা দেরি হয়ে গেছে। গত ৩০ বছরে তারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, শক্তিশালী হয়েছে। ফলে তাদের নতুনভাবে অন্য কিছু করা দরকার পড়বে আমি মনে করি না। তবে তারা বিভিন্ন জায়গায় যাবে। আপাতত চুপ থাকবে।
২০০৯ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার উদ্যোগ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। তখন থেকেই জামায়াতে ইসলামী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ হলে পরবর্তী সময়ে কী করবে তা নিয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে বলে জানা যায়। জামায়াত নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করার পর জামায়াতের বিকল্প কী হতে পারে তা নিয়ে কাজ শুরু করেন জামায়াতের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা, যারা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ও ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মীর কাশেম আলী ও কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। তাদের দুজনেরই যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তারা একে পার্টি, মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড ও মালয়েশিয়ার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সাফল্য উল্লেখ করে জামায়াতের নাম বদলের জন্য একটি ধারণাপত্রও উপস্থাপন করেন। তাতে জামায়াতের সীমাবদ্ধতার ৯টি কারণ উল্লেখ করে বিকল্প রাজনীতির দল গঠনের কথা বলা হয়। বিশ্লেষণপত্রে বলা হয়, দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর জামায়াত বাংলাদেশের মাটিতে ব্যাপক সাংগঠনিক ভিত্তি অর্জন করলেও ভোটারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমর্থন তৈরি করতে পারেনি। এটা কর্মীবাহিনীর মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জমান ২০১১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে ‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি’ শিরোনামে চিঠি দেন তৎকালীন জামায়াত নেতাদের কাছে। সেই চিঠিতে তিনি একাধিক বিকল্পের মধ্যে নতুন সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাদের এই প্রস্তাব নিয়ে দলের অব্স্থান বা কর্মকাণ্ড জানা যায়নি।
তবে জামায়াতকে সাংগঠনিকভাবে নতুন দল গঠনে আগ্রহী দেখা না গেলেও সেই সময় থেকে দ্বাদশ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দুটি নতুন দল গঠিত হয়- যেখানে শীর্ষপদে জামায়াত-শিবিরের সাবেক নেতারা অধিষ্ঠিত আছেন। দল দুটি হচ্ছেÑ আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি। এবি পার্টির আহ্বায়ক হয়েছেন জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগকারী এএফএম সোলায়মান চৌধুরী, যিনি একজন সাবেক সচিব। আর সদস্য সচিব হয়েছেন মুজিবুর রহমান মঞ্জু, যাকে জামায়াত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মঞ্জু জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য ছিলেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি হওয়ার আগে চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতির দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। এ ছাড়া দলটির সঙ্গে আরও আছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে আইনি লড়াই চালানো ব্যারিস্টার তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ প্রমুখ। দেখা যাচ্ছে, আমার বাংলাদেশ গঠনে যারা ভূমিকা পালন করছেন, তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো ভাবে জামায়াত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অথবা সহানুভূতিশীল ছিলেন। এর বাইরেও যে কয়েকজন আছেন, তারা হয় ডান বা দক্ষিণপন্থার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে যারা জামায়াত রাজনীতির বিপক্ষে তাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, এ দলটি আসলে জামায়াতেরই ‘বি’ টিম।
জামায়াত নিষিদ্ধের আশঙ্কা থেকেই প্রস্তুতিমূলকভাবে এবি পার্টি গঠিত হয়েছিল কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে এবি পার্টির প্রচার সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না। এবি পার্টি কোনো ধর্মভিত্তিক দল নয়। এটি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের গণমানুষের একটি রাজনৈতিক দল, যারা জামায়াত বা শিবির থেকে এসে এবি পার্টি গঠন করেছে। জামায়াতের মৌলিক অনেক বিষয় নিয়ে ভিন্ন চিন্তার কারণে এ সংগঠন করা হয়েছে। এবি পার্টির সঙ্গে জামায়াতের মৌলিক পার্থক্য এত বেশি সেখানে জামায়াতের চিন্তা নিয়ে কেউ এবি পার্টির রাজনীতি করতে পারবে না। এবি পার্টিতে যেভাবে নারীরা অংশ নেয় মিছিল মিটিং করে এটা কি জামায়াতের নেতারা পারবে? শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে যারা রাজাকারের সম্পৃক্ততা দেখানোর চেষ্টা করেছে একমাত্র তারাই এবি পার্টির সৃষ্টির পেছনে জামায়াতের সম্পৃক্ততা দেখে।’
এ ছাড়া যে দলটিকে জামায়াতের বিকল্প মনে করা হচ্ছে সেটি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর নতুন এই রাজনৈতিক দলটি গঠিত হয়। রাজনৈতিক মহলে শুরু হয় আলোচনা। কেননা, নতুন এই দলের নেতারা সবাই জামায়াত-শিবিরের। জানা গেছে, হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করা বিডিপির চেয়ারম্যান একেএম আনোয়ারুল ইসলাম (চান) ও সেক্রেটারি জেনারেল নিজামুল হক (নাঈম)। আনোয়ারুল ইসলাম একসময় ছাত্রদল করতেন। আর নিজামুল হক ছাত্রশিবির করতেন। পরে দুজনেই জামায়াতের রুকন (শপথধারী সদস্য) এবং ঢাকা মহানগরীর মজলিশে শুরার সদস্য হন। তারা এখনও জামায়াতে ইসলামীতেই আছেন। যদিও দলটির চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশের কাছে দাবি করেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। তারা দেশের সংবিধান মেনে রাজনীতিতে এসেছেন। তাদের দল সব দলের জন্য উন্মুক্ত। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ কোনো ব্যক্তি তাদের দলে আসতে পারবে না। কারও বারডেন আমরা নিতে যাব না।’
এ ছাড়া লেবার পার্টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিতেও (উভয় গ্রুপ) জামায়াতের কর্মীবাহিনীর আশ্রয় নেওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
জানা গেছে, লেবার পার্টির একাংশের প্রধান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ২০ দলীয় জোটের শরিক দল হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে আসছেন। বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের মঞ্চে জামায়াতকে রাখার জন্য যারা সোচ্চার তাদের অন্যতম তিনি। এ ব্যাপারে তার মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
শামসুদ্দিন পারভেজ ও আবু হানিফের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির একাংশকেও জামায়াতে বি-টিম মনে করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে এই অংশের মহাসচিব আবু হানিফ বলেন, এটা অনেক পুরোনো অভিযোগ। তবে এ বিষয়ে আমাদের ধারণা নেই।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান উপদেষ্টা শাহরিয়ার কবির মনে করেন, জামায়াত রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি আর্থিক ভিত্তিও শক্ত করেছে। তারা ব্যাংক-বীমা পরিচালনার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও এনজিও পরিচালনা করে। তাই জামায়াতের রাজনৈতিক ও আর্থিক ভিত্তি ভেঙে দিতে হবে। সরকারকে এ বিষয়ে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, এই দলের নেতাকর্মীরাও সন্ত্রাসী। তারা তো তাদের সমমনা সংগঠনগুলোতেও ঢুকবেই। পরিচয় গোপন করে আওয়ামী লীগসহ অঙ্গদলগুলোতেও ঢুকে যায় কি না, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। এরই মধ্যে তারা অনুপ্রবেশ করেছে কি না, তাই বা কে নিশ্চিত করবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ জামায়াতের শিকড় হিসেবে ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করেছিল। গত বৃহস্পতিবার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে গেজেট প্রকাশের পর গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার তার প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের তদন্ত দাবি করেন। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পর জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন আর্থিক, সেবামূলক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ৫৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে পুলিশও জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১২৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে ৩৭৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছিল।