সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৪ ০৮:১৭ এএম
দেশে ডাক বিভাগের অব্যবস্থাপনা ও সেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে কুরিয়ার সার্ভিসের প্রসার ঘটে। দ্রুততম সময়ে যথাযথভাবে সেবা দিয়ে দেশে কুরিয়ার সার্ভিস একসময় সুনাম অর্জন করলেও সম্প্রতি কুরিয়ার সার্ভিস ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে এরই সাক্ষ্য মিলেছে। ‘চোরাচালানের ঢাল হয়ে উড়ছে কুরিয়ার সার্ভিস’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের গর্ভে যে তথ্য উঠে এসেছে তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এর আগেও কুরিয়ারে মাদক-অবৈধ অস্ত্র ও বিভিন্ন নিষিদ্ধ পণ্য দেশে-বিদেশে পাচার হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে এই তথ্য উঠে এলেও প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে প্রতীয়মান হয়, কুরিয়ারের সেবার নামে নৈরাজ্য রীতিমতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে, নামে-বেনামে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক অবৈধ প্রতিষ্ঠান এবং এর বেশিরভাগেরই নেই
বৈধ লাইসেন্স! ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন কুরিয়ারের নামে মাদক পাচারের ৬৫টি মামলা
হয়েছে। বিস্ময়কর হলো, অবৈধ সার্ভিসের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে প্রতিবিধানের যে
পথ অবলম্বন করা দরকার সেদিকেও রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে
আরও বলা হয়েছে, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচারের ঘটনা নজরে আসার পর থেকে অভিযান
চালিয়ে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত আছে। কোনো কোনো কুরিয়ার সার্ভিসের দেশের
বাইরেও কার্যক্রম রয়েছে। গত মার্চে রাজধানীতে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে
মাদকসহ একজন পাচারকারীকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুসন্ধানী দল আটক করে। এর
পূর্বাপর আরও অনেক ঘটনাই ঘটেছে। দেশের নামকরা কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য কুরিয়ার
সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ক্রমেই স্তূপীকৃত হচ্ছে। গ্রাহকসেবার নামে অযৌক্তিক হারে
মাশুল আদায়ের পাশাপাশি পণ্য গায়েবের অভিযোগও কম নেই। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক
কিংবা অস্ত্র পাচারের মতো ঘটনা নিঃসন্দেহে গুরুতর অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত। ইতোমধ্যে
ঢাকাসহ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন কুরিয়ার কার্যালয়ে কয়েক দফা অভিযান পরিচালিত হলেও প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন সাক্ষ্য দিচ্ছে অপরাধের মাত্রা কমছে না। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে
এ-ও উঠে এসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নজরদারি বাড়ালে অস্ত্র ও মাদক
কারবারিরাও কৌশল পাল্টে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। এ থেকে এ-ও প্রতীয়মান হয়, কুরিয়ার সার্ভিসসেবার
নামে অবৈধভাবে অর্থ কামাইয়ের শুধু কদর্য পথই বেছে নেয়নি অপরাধের ক্রমবিস্তৃতিও ঘটিয়ে
চলেছে।
জরুরি প্রয়োজনে
দিন দিন মানুষের সঙ্গী হয়ে উঠেছে যে কুরিয়ার সার্ভিস সেই ক্ষেত্রটি অপরাধীদের চারণভূমি
হয়ে উঠল কীভাবে? আমাদের বক্তব্য, নজর দিতে হবে এর উৎসে। কুরিয়ারবিধি ও নির্দেশনা অনুযায়ী
প্রতিটি সার্ভিসের প্রধান ও শাখা বা এজেন্ট অফিসগুলোতে সিসি ক্যামেরা থাকতে হবে। তাতে
কেউ কোনো অবৈধ পণ্য বুকিং করে থাকলে শনাক্ত করা যেমন সহজ হবে তেমনি বুকিং ডেলিভারি
নেওয়ার সময় বুকিংদাতার সামনে প্যাকেট খুলে চেক করে নিতে হবে। সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ
প্রতিটি কুরিয়ার সার্ভিসে স্ক্যানারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা দেখছি, এসব
নিয়মের ব্যত্যয় অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে চলেছে এবং এর সুযোগে বাড়ছে অবৈধ পণ্য পাচারের ঘটনা।
কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা তদারকি প্রতিষ্ঠান ‘মেইলিং অপারেটর অ্যান্ড কুরিয়ার সার্ভিস
লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ’ নির্ধারিত ফি নিয়ে সরকারিভাবে লাইসেন্স দিয়ে থাকে। এই বিধির
বাইরে কারও লাইসেন্স পাওয়া এবং ব্যবসা পরিচালনা করার অবকাশ না থাকলেও কীভাবে আনাচকানাচে
নামে-বেনামে অবৈধ কুরিয়ার সার্ভিস রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান
জরুরি। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া
তালিকায় লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে এমন কুরিয়ারের মধ্যে দেশের নামি কুরিয়ারও
অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পোস্ট অফিস অ্যাক্ট অনুযায়ী প্রণীত বিধিমালায় বলা হয়েছে, লাইসেন্স
ছাড়া কোনো মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে
না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিধিবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন শক্তিবলে তারা ব্যবসা চালিয়ে
যাচ্ছে?
কুরিয়ার সার্ভিসের
বর্তমান যে অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা এক কথায় নৈরাজ্যকর। আমরা মনে করি, জাতীয় ভোক্তা
অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষসহ সচেতনদের সামাজিক ভূমিকাতেও প্রয়োজন। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো
জরুরি। একই সঙ্গে বিধিবিধানের প্রতিপালন যাতে অনুসরণ করা হয় এ ব্যাপারে মনোযোগ গভীর
করার বিকল্প নেই। বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর
নিয়মিত অভিযানের তাগিদও আমরা দিই। যেসব প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে তারাসহ
অবৈধভাবে যারা ব্যবসা পরিচালনা করছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে
হবে সময়ক্ষেপণ না করে। কুরিয়ারের বাজার বাড়ছে তবে তা অনিয়ন্ত্রিতভাবে। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
ছাড়া শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, দেশে গত করোনা দুর্যোগে ঘরবন্দি মানুষের
নিত্যপণ্য, খাবার, ওষুধ ইত্যাদি হাতে পেতে জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কুরিয়ারের
ওপর অধিক নির্ভর হয়ে পড়ে। সচেতন সবার সামাজিকভাবে ভূমিকা রাখা বাঞ্ছনীয়। সংবাদমাধ্যমের
ভিন্ন এক তথ্যে জানা যায়, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের অসাধুদের সঙ্গে যোগসাজশে অবৈধ ব্যবসা
চালাচ্ছে অনেক কুরিয়ার সার্ভিস। কী করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই খাত বেড়ে উঠছে এ প্রশ্নের
উত্তর দেওয়ার দায়ও সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই এড়াতে পারে না। আমাদের স্মরণে আছে, একটি কুরিয়ার
সার্ভিসের কর্ণধার প্রতারণার ফাঁদ পেতে কীভাবে জাল বিস্তৃত করে অনেককেই নিঃস্ব করেছিলেন।
এর আইনানুগ প্রতিবিধান হলেও এরপরও কী করে অবৈধ ব্যবসার পরিসর বাড়ছে এই প্রশ্নের উত্তর
অনুসন্ধানের মধ্যেই প্রতিবিধানের পথ বের করতেই হবে বলেও আমরা মনে করি।
একই সঙ্গে আমরা
গুরুত্ব দিই ডাক বিভাগের আধুনিকায়নে। বেসরকারি খাতে ব্যবসা প্রসারের বিরুদ্ধে আমরা
নই। তবে তা যাতে নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলে তা নিশ্চিত করতে হবে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার
সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এ ব্যাপারে যূথবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আমরা মনে করি, নজরদারি-তদারকির
অভাবে একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অসাধু দায়িত্বশীলদের যোগসাজশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব
হয়েছে। এর নিরসন করতে হবে। ডাক বিভাগের প্রতি মানুষের হৃত আস্থা পুনরুদ্ধারে জরুরি
যথাযথ কর্মপরিকল্পনা। সেবার আড়ালে কুরিয়ারের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কোনোভাবেই চলতে পারে
না।