× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সমাজ

একটি মুচলেকা কিন্তু প্রশ্ন অনেক

মহিউদ্দিন খান মোহন

প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৪ ০৯:৫৭ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন

মহিউদ্দিন খান মোহন

গত বছরের ১২ আগস্ট মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার চন্দ্রের বাড়ির একটি কমিউনিটি সেন্টারে সামাজিক সংগঠন ‘অবারিত বাংলা’ সংবর্ধনা দিয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৫ নম্বর আসামি নৌ-সেনা নূর মোহাম্মদ ওরফে ক্যাপ্টেন বাবুলকে। নবতিপর নূর মোহাম্মদ বর্তমানে ফরিদপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও তার পৈতৃকনিবাস লৌহজংয়ের কুমারভোগ গ্রামে। নূর মোহাম্মদ সাহেব তার পৈতৃক সম্পত্তির খোঁজখবর নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন সংগঠনটির উদ্যোক্তাদের। লৌহজং কলেজের অধ্যক্ষ নূর মোহাম্মদ সাহেবের জমিজমার দলিল খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে সাব-রেজিস্ট্রারের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে এও বলেছিলেন, নূর মোহাম্মদ একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন।

সাব-রেজিস্ট্রার মহোদয় অধ্যক্ষকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কার পক্ষে এসেছেন- আসামি নাকি বাদীর?’ শুনে তো অধ্যক্ষের আক্কেল গুড়ুম। জবাবে তিনি বললেন, আপনি ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা শোনেননি? সাব-রেজিস্ট্রার জানালেন এ ধরনের কোনো মামলার কথা তার জানা নেই! ঘটনাটি বিস্ময়কর সন্দেহ নেই। কেননা, এখনও বাংলাদেশে পঁয়ষট্টি-সত্তরোর্ধ্ব এমন কোনো মানুষ নেই যারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও এর বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের কথা জানেন না। পরবর্তী প্রজন্মের যারা রাজনীতিচর্চা করেছেন, বইপুস্তকের (ক্লাসের বই ছাড়া) সঙ্গে যাদের সম্পর্ক রয়েছে, তারাও ওই মামলা সম্পর্কে সম্যক অবগত। যে মামলা নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’র আসনে বসাল, যে মামলা তাঁকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের একক নেতায় পরিণত করল এবং এরই ধারাবাহিকতায় তিনি হলেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা; ওই মামলা সম্পর্কে স্বাধীন বাংলাদেশের একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা অজ্ঞ থাকবেন- এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে!

আমাদের বড় দুর্ভাগ্য আমরা তাদের দ্বারাই এখন শাসিত হচ্ছি। দেশের ইতিহাস- ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই, এমন কর্তারা এখন ছড়ি ঘোরান আমাদের ওপর। তাদের দাপট এতটাই, সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয় কখন ‘পান থেকে চুন খসা’র অভিযোগে তারা রাজদণ্ড প্রয়োগ করে বসেন। ওপরের ঘটনাটি মনে পড়ল, ৩০ এপ্রিল একটি দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘মুচলেকায় জামিন’ শীর্ষক খবরটি পড়ে। ঘটনাস্থল শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলা। সঞ্জয় রক্ষিত নামে এক ব্যক্তি মরমি সাধক লালন সাঁইয়ের একটি গানের কয়েকটি কলি উদ্ধৃত করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। তাতে ‘ধর্মীয় অনুভূতি’তে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ ২৮ এপ্রিল ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। ২৯ এপ্রিল উপজেলার আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ‘মুচলেকা’ নিয়ে তার জামিন মঞ্জুর করেন। এ ব্যাপারে ভেদরগঞ্জ থানার ওসি বলেছেন, স্থানীয় কয়েকজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল

ঘটনাটি বিস্ময়কর! কেননা, লালন সাঁই আমাদের একজন কিংবদন্তি সাধক-পুরুষ। শতাধিক বছর ধরে তার গান এপার বাংলা-ওপার বাংলায় গীত এবং সমাদৃত হয়ে আসছে; যা লালনগীতি নামে পরিচিত। এর আগে কখনোই তার গানের কোনো বাণী কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে বলে অভিযোগ ওঠেনি। হঠাৎ ভেদরগঞ্জের ‘কতিপয় ব্যক্তির’ ধর্মীয় চেতনা কেন এতটা প্রবল হয়ে উঠল বোঝা গেল না। সমাজমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা চলছে। জানা গেছে, ওই ব্যক্তি লালন সাঁইয়ের ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’ গানের ‘ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারী লোকের কী হয় বিধান/বামন চিনি পৈতে প্রমাণ/বামণি চিনি কিসে রে...’ কলি কটি উদ্ধৃত করেছিলেন। পোস্টে সঞ্জয়ের নিজের কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য ছিল না। একজন কিংবদন্তি আধ্যাত্মিক সাধকের কালজয়ী একটি গানের কলি কীভাবে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে আমার মতো গো-মূর্খের বোধগম্য হচ্ছে না।

লালন সাঁই কিন্তু তার গানে শুধু মুসলমানের ‘ছুন্নত দেওয়া’ অর্থাৎ খতনার কথাই বলেননি, তিনি হিন্দু ব্রাহ্মণের পৈতার কথাও বলেছেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পাওয়া (?) যেসব ক্ষুব্ধ ব্যক্তি ওসি সাহেবের কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন, তারা হিন্দু না মুসলমান তা বলেননি তিনি। তবে যারাই হোক, তারা যে ধর্মীয় জ্ঞানে নিতান্তই খাঁটো এবং লালন সাঁইয়ের গানের মর্মার্থ অনুধাবনের ক্ষমতা তাদের নেই, তা না বললেও চলে। প্রশ্ন হচ্ছেÑথানার ওসি কোনো কিছু যাচাই না করে কয়েক ব্যক্তির অভিযোগ পেয়েই লোকটিকে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন কোন যুক্তিতে? তার তো লালন সাঁইয়ের ওই গানটি শুনে মর্মার্থ অনুধাবন করে তা কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে কি না বিচার করে দেখা উচিত ছিল। হতে পারে ওসি সাহেবের লালন সাঁইয়ের গান সম্পর্কে ধারণা নেই, কিংবা তা শোনার ফুরসতও পান না। তবে বিষয়টি তলিয়ে দেখার জন্য এলাকার শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন। তা করেননি। তিনি ‘চিলে কান নিয়ে গেছে’ শুনেই চিলের পেছনে ছুট দিয়েছেন। হাত দিয়ে দেখেননি কান যথাস্থানে আছে কি না। অন্যদিকে ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ও কি খুব ভেবেচিন্তে আদেশ দিয়েছেন?

শত বছরেও যে গান বা গানের বাণী সম্পর্কে কোনো আপত্তি ওঠেনি, হঠাৎ কয়েকজন লোকের ধর্মীয় আনুভূতিতে তা কীভাবে আঘাত করল যাচাই করা উচিত ছিল। আর সেটা করলে ওই অভিযোগ আমলযোগ্য হতো মনে হয় না। আসলে মূল সমস্যা অজ্ঞতা। যে অজ্ঞতার কারণে লৌহজংয়ের সাব-রেজিস্ট্রার প্রিন্সিপালকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিপক্ষের নাকি বাদীপক্ষের লোক। একই কারণে ভেদরগঞ্জের ওসি অভিযোগ পাওয়া মাত্রই সঞ্জয় রক্ষিতকে গারদে ঢুকিয়ে দিলেন! ভেবে দেখেননি, লোকটা আসলে অপরাধী কি না বা কতটুকু অপরাধী। এ ধরনের অজ্ঞতা সময়ে সময়ে নানান অস্বস্তিকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়।

আমাদের সমাজে তিলকে তাল বানানোর কারিগরের অভাব অতীতেও ছিল না, এখনও নেই। এরা বরাবরই শুভবোধের বিপরীতে থাকে। এরা শত শত ইসলামি গান লেখা সত্ত্বেও কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘কাফের’ আখ্যা দিয়েছিল। তাদের উদ্দেশেই কবি তার ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় লিখেছেনÑ‘ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও/যদিও শহীদ হইতে রাজী ও/আমপারা পড়া হামবড়া মোরা, এখনও বেড়াই ভাত মেরে/দেব-দেবী নাম মুখে আনে ব্যাটা, দাও পাঁজিটার জাত মেরে।’ এ হামবড়াদের মূর্খতার কারণেই সমাজে সৃষ্টি হয় নানা বিশৃঙ্খলার, নষ্ট হয় সম্প্রীতি। এ সম্পর্কে সবার সজাগ হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

  • সাংবাদিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা