নারীর অগ্রগতি-নিরাপত্তা
এলিনা খান
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৪ ১০:২৬ এএম
এলিনা খান
পিএসসি প্রকাশিত ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ৪৩তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২ হাজার ১৬৩ জনকে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র ৪২১ জন। বাকি ১ হাজার ৭৪২ জনই পুরুষ। শতাংশের হিসাবে নারীদের এ বিসিএসে নিয়োগের হার মাত্র ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর দৃশ্যমান সাফল্য পরিলক্ষিত হলেও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারী নানা কারণে পিছিয়ে পড়ছেন। তবে এই প্রতিবন্ধকতা শুধু আমাদের দেশের নারীর জন্যই বড় সমস্যা তা নয়। গোটা বিশ্বেই কর্মক্ষেত্রে নারীকে নতুন সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে। এক্ষেত্রে নারীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিচার করা জরুরি। একজন নারী মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত তার পরিবারের তত্ত্বাবধানেই থাকেন। শিক্ষাস্তরের এ পর্যায় পর্যন্ত তাকে নির্দিষ্ট এই গণ্ডির মধ্যেই শিক্ষাজীবন পার করতে হয়। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নারী শিক্ষার্থীর প্রতি অভিভাবকদের বাড়তি মনোযোগ থাকে। অভিভাবকের সার্বিক তত্ত্বাবধানের মধ্যেও শিক্ষাক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীদের যৌন নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়।
সম্প্রতি রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলসহ বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে
শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠে এবং অনেকাংশেই সত্যতাও মিলেছে। এতদসত্ত্বেও উচ্চ
মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত অভিভাবকের তত্ত্বাবধায়নে থাকায় নারী শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল
করার উৎসাহ-উদ্দীপনা পেয়ে থাকেন। স্নাতক পর্যায়ে নারী অভিভাবকের ওই অভিভাবকত্ব আর পান
না। স্নাতক সম্পন্নের শেষদিকে কিংবা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধিকাংশ নারী যখন চাকরি কিংবা
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন তখন তাকে সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক
নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষত স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নারীদের এখনও
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সিনিয়র বা সহপাঠীদের কুনজরে পড়তে হয়। অনেক সময় যৌন নিপীড়নের
তুলনায় এই কুনজরের বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নারীর জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে ওঠে।
আর প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যখন কোনো নারী এই কুনজর সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন তখন ভবিষ্যৎ
নিয়ে ওই নারীর যে ভাবনা বা আকাঙ্ক্ষা থাকে তাও হুমকির মুখে পড়ে। সামাজিক পর্যায়ে নারীর
মনস্তাত্ত্বিক ও পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর এই বাধা থেকে আমরা এখনও বেরোতে পারিনি।
নারীর অগ্রগতি নিয়ে ইতোমধ্যে কথা কম হয়নি। অনেকেই নারীর অগ্রগতি-নিরাপত্তা
নিয়েও বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করেন এবং নারীর অধিকার আদায়ের পক্ষে অবস্থানও নিয়ে থাকেন।
কিন্তু সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাববলয় থেকে তাদের অনেকেই মুক্ত নন। ফলে আমরা দেখছি,
এই মানুষদেরও অনেকে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে নারীর ওপর নিপীড়ন চালান। বেসরকারি নানা সংস্থায়
নারী নিজ যোগ্যতাবলে কাজ পেলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাকে একধরনের নেতিবাচক মনোভাবের সম্মুখীন
হতে হয়। নারীকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নেতিবাচক ধারনা কর্মস্থলে গুজবে রূপ নেয়। এই গুজবও
নারীর অগ্রগতির পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত নারীর পদোন্নয়নের ক্ষেত্রে
এখনও নারীকে অসহায় ভেবে তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা,
এই অভিযোগ নতুন নয়। দেশে বেকারত্ব দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে মানুষ
একটি চাকরির প্রত্যাশা করে।
অনেকে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার চেষ্টা বা তদবির করেন এ
অভিযোগও পুরোনো। নারীর ক্ষেত্রে ঘুষ তদবির বাদেও তাকে কুপ্রস্তাবও দেওয়া হয়। ফলে অনেক
নারী সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না। এত সংকটের
মধ্যে কজনের পক্ষে সম্ভব নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা? শহরে নারী কর্মীর সংখ্যা আমলে নিয়ে
সারা দেশে নারীর কর্মসংস্থানের তুলনা করতে গেলে আমরা কিছুটা ভুল ধারণা পেতে পারি। নারীর
সুযোগ-সুবিধা যে বেড়েছে এর সত্যতা অবশ্য আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু সার্বিকভাবে নারীর
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা পুরোপুরি দূর হয়নি। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও নারী প্রাতিষ্ঠানিক
বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, এ অভিযোগও আছে। নিয়োগদাতা সংস্থায় যে নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল
ব্যক্তি নেই এমনটি নয়। কিন্তু এমন ব্যক্তির সংখ্যাও কম। সমস্যা হলো, দেশে যোগ্য নারী
শিক্ষার্থীর তুলনায় যোগ্য কর্মী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। তারপরও
কিছুসংখ্যক নারী নিজ যোগ্যতাবলে কর্মসংস্থান গড়ে তুলছেন।
নারীর কর্মসংস্থানে পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে তাদের মানসিক ভাবনাগত সংকটও
রয়েছে। এখনও অনেক নারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও চাকরির ক্ষেত্র সম্পর্কে
সঠিক জ্ঞান নেন না। তার নিজস্ব দক্ষতা কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে কেমন
চাকরি তিনি পেতে পারেন এ বিষয়ে কোনো ধারণা অর্জন করেন না। যেহেতু তিনি চাকরির বাজার
সম্পর্কে অবহিত নন সেহেতু এক পর্যায়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। আত্মবিশ্বাসহীনতার
কারণে অনেক নারী তার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে বিয়ে করে ফেলেন। এভাবেই অনেক নারী উচ্চশিক্ষা
নেওয়ার পরও স্বামীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। এমন অনেক পরিবার রয়েছে যেসব পরিবারে নারীকে
উচ্চতর শিক্ষা নিতে পাঠানো হয় যাতে তার ভালো একটি বিয়ের সম্বন্ধ আসে।
নারীর আত্মমর্যাদা বা তার নিজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠার বিষয়ে পরামর্শ
দেওয়া হয় কম। এসব কিছুই নারীর কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণের পথে প্রতিবন্ধকতা। নারী যখন
পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন তখন তিনি নিজেও কর্মসংস্থানে যোগ দেওয়ার বিষয়টিকে এত
গুরুত্ব দেন না। অনেক ক্ষেত্রে সাংসারিক চাপ তাকে চাকরি করার বিষয়ে অনুৎসাহিত করে।
এ ছাড়া নারীর নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে তাদের দমিয়ে দেয়। এসবই সামাজিক
প্রেক্ষাপটে নারীর নিজের সৃষ্ট সংকট। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুযোগ একটি বড় বিষয়। পুরুষ-নারী
উভয়ের ক্ষেত্রেই চাকরির ক্ষেত্র ও সুযোগের বিষয়টিকে আমলে নিয়ে কাজ খুঁজতে হয়। কিন্তু
দেশের নারী এখনও এ বিষয়ে পর্যাপ্ত সচেতন হয়ে উঠেছেন এমনটি বলা যাবে না।
দেশে কর্মক্ষেত্রে মেধাবৈষম্যও নারীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এমন অনেক
খাত রয়েছে যেখানে নারীর তুলনায় পুরুষের মেধাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অবশ্যই ঝুঁকি
ও দক্ষতার ভিত্তিতে একেকটি খাত একেক রকম। সব খাতেই নারী-পুরুষ সমানভাবে অংশ নিতে পারবে
এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন খাতে নারী-পুরুষ সমান অংশগ্রহণের
সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। এসব খাতে নারীর মেধাকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। এই অবমূল্যায়নের
ফলে অনেক নারী কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের আগেই হীনম্মন্যতায় ভোগেন। কর্মক্ষেত্র প্রসঙ্গে
নারীর মধ্যেও একচোখা মনোভাব রয়েছে, এও ভুল অভিযোগ নয়। অপরদিকে পুরুষরা একপক্ষীয়ভাবে
ধরে নেন একজন নারীর পক্ষে অনেক খাতে কাজ করা সম্ভব নয়। দুটো অংশেই এমন একচোখা মনোভাব
ইতিবাচক ফলাফল এনে দিতে পারে না। আমাদের মতো জনসংখ্যাবহুল এই দেশে দক্ষ জনসম্পদ গড়ে
তোলার জন্য নারী-পুরুষ উভয়ের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ইতোমধ্যে
আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। কিন্তু সামাজিক পর্যায়ে নারীকে যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে
তা নির্মূলে এখনও অনেক কাজ বাকি।
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং সামাজিক পরিবর্তনে আমাদের বাড়তি মনোযোগ
রাখার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। নারী-পুরুষ সমতা বিধানের বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে আলোচনা
করেছি অনেক। কিন্তু নারীরা যে এখনও অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছেন কিংবা পড়ছেন এদিকে
আমরা এখনও মনোযোগ দিতে পারিনি।
নারীর অগ্রগতি নিশ্চিত করার মানে এই নয়, পুরুষকে পিছিয়ে পড়তে হবে। বরং নারীর দক্ষতা ও যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দিয়ে তার মেধার মূল্যায়নের ওপর জোর বাড়াতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে বিভিন্ন সময়ে বৈষম্যের দিকে ঠেলে দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেওয়ার মাধ্যমেই আমরা ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে এগোতে পারি। দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্য পূরণে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি গোটা বিশ্বেই ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদেরও এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। নারীকে নিপীড়ন করার সুপ্ত যে প্রবণতা এখনও অনেকের মধ্যে রয়েছে তা সামাজিক নানা প্রভাবেই হয়ে থাকে। পশ্চাৎপদ চিন্তার মানুষদের এ থেকে বের করে আনতে হবে। নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে নারীর প্রতি অবজ্ঞা কিংবা অবমূল্যায়নের অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসবে সমাজ।