সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৪ ১৩:৫০ পিএম
খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন বলেছিলেন, ‘চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না।’ কালখ্যাত এই চিত্রশিল্পীর মন্তব্যের সঙ্গে ৯ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত ‘মাটির গভীরে দুর্নীতি’ শিরোনামযুক্ত প্রতিবেদনটির গর্ভে যা উঠে এসেছে সত্যিই এরও যেন কোনো ছবি হয় না। দুর্নীতি নির্মূলে সরকারের যেখানে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র অঙ্গীকার রয়েছে সেখানে সংবাদমাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতির যে চিত্র এখনও উঠে আসে তা বিস্ময়কর একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতার উৎস কী, এ প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসে।
মাদারীপুরে আশ্রয়কেন্দ্রের
তিনতলা ভবন নির্মাণকাজ যেন কদাচারের খতিয়ান। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মারুফ ইন্টারন্যাশনাল
নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন ভবন নির্মাণের
আগে সয়েল টেস্টে দেখা যায়, সেখানের মাটির গুণগত মান ভবন নির্মাণের জন্য খুব একটা উপযোগী
নয়। ফলে ডিজাইনের সময় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী পাইলিংয়ের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করে দেন ৭০ থেকে
৭২ ফুট। ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে
শুরু থেকেই অনিয়ম ধরা পড়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজে। ডিজাইনের পাইলিংয়ের শর্ত মানেনি
তারা। ড্রয়িং অনুযায়ী ২ ফুট ল্যাকিংসহ ৭২ ফুট গভীর পর্যন্ত পাইল বসানোর কথা থাকলেও
তারা মোট ৫৪টির মধ্যে ৪৯টি পাইলিংই করেছে ৩০ ফুট করে! কেবল যেদিন প্রকৌশলীর উপস্থিতিতে
কাজের উদ্বোধন হয় সেদিন একটি পাইলিংয়ের কাজ সঠিকভাবে করা হয়। এর পরের প্রায় সবই পড়ে
‘রাহুগ্রাসে’।
এস্টিমেট অনুযায়ী
প্রতিটি পাইলিংয়ে যেখানে ২২ থেকে ২৭ ব্যাগ সিমেন্ট লাগার কথা সেখানে ৭ থেকে ৮ ব্যাগ
সিমেন্ট দিয়েই কাজ শেষ করা হয়েছে! এই ‘সাগরচুরি’র ব্যাপারে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার
অফিসের অসাধু ব্যক্তিদেরও সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে এসেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ
প্রতিমন্ত্রী এ ব্যাপারে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে
গিয়ে বলেছেন, ‘প্রকল্প নিয়ে কোনো রকম দুর্নীতি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর
ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ আমরা দেখছি, অনেক প্রকল্পের ক্ষেত্রেই অনিয়ম-দুর্নীতির ভয়াবহ
অনেক চিত্র ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। এর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট
ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে প্রায় একই রকম উত্তর পাওয়া যায় অনিয়ম-দুর্নীতি
হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এ-ও দেখছি;
এই ‘হবে’ কিংবা ‘হচ্ছে’র জটাজাল যেন আর কোনোভাবেই ছিন্ন হয় না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে
জার্মানির বার্লিন থেকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) দুর্নীতির যে ধারণাসূচক
(সিপিআই) প্রতিবেদন-২০২৩ প্রকাশ করে তাতে বলা হয়েছে, তাদের তথ্য অনুযায়ী দুর্নীতির
মাত্রার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। ২০২২ সালে ছিল ১২তম। সরকারের কঠোর অবস্থান
এবং অঙ্গীকার সত্ত্বেও দেশে দুর্নীতি যে কমেনি তা জানতে টিআই কিংবা অন্য কোনো সংস্থার
জরিপের প্রয়োজন হয় না। কারণ সংবাদমাধ্যমে দুর্নীতি ও দুর্নীতির অনুঘটকদের যে তথ্য প্রায়ই
উঠে আসে এবং তাতেও প্রশ্ন জাগে, দুর্নীতিবাজদের শক্তির উৎসই বা কী? এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই
অতীতেও আমরা বলেছি, সরকার যদি সত্যি সত্যি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে চায় তাহলে সংশ্লিষ্ট
ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মনস্তত্ত্ব পাল্টাতে হবে এবং দুর্নীতিবাজ যে-ই হোক
নির্মোহ অবস্থান থেকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দুর্নীতি নির্মূলে
জবাবদিহি ও সুশাসনের বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, কার আমলে কত বেশি দুর্নীতি হয়েছে সেই
পরিসংখ্যানের চেয়েও জরুরি হলো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান নেওয়া এবং রাজনৈতিক
স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনা। ‘হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে’
এমন চিন্তা তর্কাতীতভাবে আত্মঘাতীর শামিল। আমরা আরও মনে করি, নীতিনির্ধারকদের অবস্থান
হওয়া জরুরি শতভাগ নির্মোহ ও অনুকম্পাহীন। যেকোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন
হলে তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে না দিয়ে আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখে সময়ক্ষেপণ না করে যথাযথ প্রতিবিধান
নিশ্চিত করা জরুরি বলেও আমরা মনে করি। বিগত দেড় দশকে উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে দেশে
যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা কোনো রূপকথার গল্প নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। যদি
সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা-দায়বদ্ধতা-জবাবদিহি নিশ্চিত হতো এবং অনিয়ম-দুর্নীতির অপচ্ছায়া
সরানো যেত তাহলে উন্নয়ন-অগ্রগতির মহাসড়ক যে আরও মসৃণ হতো, তা-ও তর্কাতীত। দুর্নীতির
কারণেই অর্থ পাচার হচ্ছে, আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে
রক্ষকরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার এ বার্তাও সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। এ প্রেক্ষাপটেও
প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা কীভাবে সম্ভব। দুর্নীতি রোধে এবং মানবাধিকারের
সুরক্ষায় জনমত আমলে নেওয়া প্রয়োজন। কে কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করল কিংবা কার অনুরাগ-বিরাগ
গুরুত্ব পাবে এসব বিবেচনায় রাখলে দুর্নীতি নামক ভয়াবহ ব্যাধির উপশম ঘটানো দুরূহ।
দুর্নীতি উৎসাহিত
হয় এমন বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে শূন্য
সহিষ্ণু নীতি রয়েছে এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছু যাতে সৃষ্টি না হয়, তা-ও গভীরভাবে
আমলে রাখতে হবে। নিয়মনীতির ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি, যাতে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে
বৈষম্য সৃষ্টি না করে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণু তো কথা নয়, কাজের মধ্য দিয়ে
তা প্রমাণ করতে হবে। এটি দেশবাসীর স্বাভাবিক প্রত্যাশা। সরকারের তরফে কঠোর কার্যকর
উদ্যোগের পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের
উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে, সরকারি অসাধু কর্মকর্তারা,
এই অভিযোগ নতুন নয়। আমরা দেখছি মাদারীপুরের মাটির ‘গভীরে’ যে দুর্নীতি হয়েছে, এর পেছনেও
ওই অসাধু ব্যক্তিদের যোগসাজশ রয়েছে। আমাদের স্মরণে আছে হাইকোর্টের এক রায়ে যথার্থই
বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রের পদমর্যাদাক্রমের (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) আওতাভুক্ত ব্যক্তিরা
দুর্নীতিমুক্ত হলে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হতে বাধ্য। ‘মো. কামরুজ্জামান সরকার বনাম রাষ্ট্র
ও অন্য’ শীর্ষক মামলার রায়ে এ অভিমত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্টের একক ব্র্যাঞ্চ
ব্যক্ত করেছিলেন।
দুর্নীতি নিঃসন্দেহে
রাষ্ট্রের অন্যতম সংকট। একদিকে দুর্নীতি দেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে
তা দুর্বলতমদের ওপরে অসামঞ্জস্য প্রভাব ফেলে এবং আয় হ্রাস পাওয়া, ব্যয় বৃদ্ধি, ন্যায়বিচারসহ
নাগরিক সমাজ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়। মাদারীপুরে আশ্রয়কেন্দ্রে ভবন নির্মাণে অনিয়মের
যে চিত্র উঠে এসেছে তা একদিকে রাষ্ট্রের ক্ষতি অন্যদিকে জনস্বার্থে অভিঘাত। এর প্রতিবিধান
অবশ্যই দৃষ্টান্তযোগ্য করতে হবে এবং দুর্নীতির সব রন্ধ্র বন্ধ করতে হবে রাজনৈতিক স্বার্থের
হিসাব বাদ দিয়ে। দুষ্টচক্রের তো বটেই তাদের প্রতিপালকদেরও সমগুরুত্বেই আনতে হবে আইনের
আওতায়। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে একেবারে গভীর থেকেই।